সফর ভুলে এটিএমে বিদেশি পর্যটকরা

পুরনো টাকা বাতিলের জেরে সমস্যায় অসমের পর্যটকরা। কাজিরাঙা, মানস, কামাখ্যা বা শিলং ঘুরতে গিয়ে তাঁরা ৫০০ বা ১ হাজার টাকার নোট ভাঙাতে পারছেন না। অনেককে বাতিল করতে হচ্ছে বেড়ানোর পরিকল্পনা। অনেকে লাইন দিচ্ছেন এটিএমের সামনে। হোটেলের বিল মেটাতেও সমস্যা হচ্ছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

গুয়াহাটি ও হাইলাকান্দি শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৫
Share:

নোট-ভাষণ। নতুন ২ হাজার টাকার নোটের অ্যাপ-এ নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা। রবিবার করিমগঞ্জে। ছবি: উত্তম মুহরী

পুরনো টাকা বাতিলের জেরে সমস্যায় অসমের পর্যটকরা। কাজিরাঙা, মানস, কামাখ্যা বা শিলং ঘুরতে গিয়ে তাঁরা ৫০০ বা ১ হাজার টাকার নোট ভাঙাতে পারছেন না। অনেককে বাতিল করতে হচ্ছে বেড়ানোর পরিকল্পনা। অনেকে লাইন দিচ্ছেন এটিএমের সামনে। হোটেলের বিল মেটাতেও সমস্যা হচ্ছে।

Advertisement

অন্য দিকে, উত্তর-পূর্বের করমুক্ত উপজাতিভুক্ত ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কালো টাকা সাদা করার চেষ্টা হচ্ছে বলে জানতে পেরেছে আয়কর দফতর। সতর্ক করা হয়েছে ব্যাঙ্কগুলিকে।

নোট-সঙ্কটে সব চেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন বিদেশি পর্যটকরা। অনেকেই ৮ নভেম্বরের আগে ভারতে এসেছেন। পৌঁছেছেন কাজিরাঙা, মাজুলি, বরপেটা, শিলং বা অরুণাচলপ্রদেশের বিভিন্ন পর্যটন গন্তব্যে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণার পর তাঁদের সব পরিকল্পনা কার্যত ভেস্তে যাওয়ার মুখে। শিলং, কাজিরাঙা বা তাওয়াং— কোথাও হোটেল, রেস্তোঁরা, ট্যাক্সি পুরনো টাকা নিচ্ছে না। ব্যাঙ্ক খুঁজে বের করলেও মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকার বেশি বদলাতে পারছেন না তাঁরা। যে টাকা বেড়াতে গেলে এক দিনেই খরচ হয়ে যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ট্যাক্সি চালক, দোকানদার বা আমজনতা বিদেশীদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। পর্যটকদের পুরনো নোটের বিনিময়ে কমিশন রেখেও ১০০ টাকা বা ২ হাজার টাকা দিয়েছেন তাঁরা।

Advertisement

পর্যটন সংস্থাগুলিও জানাচ্ছে, অক্টোবর-ডিসেম্বরে পর্যটনের প্রধান মরসুমে টাকা বাতিলের ধাক্কায় পর্যটন ব্যবসা মার খাচ্ছে। হোটেলের বিল ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডে মেটালেও গাড়ি ভাড়া, সাফারির টিকিট নগদে কাটতে হয়। সব রেস্তোঁরা কার্ড নেয় না। ফলে বাইরে থেকে পর্যটক নিয়ে আসা সংস্থাগুলিকে হয়রান হতে হচ্ছে। পর্যটকরা দিনে মাত্র ২ হাজার টাকা তুলে সব বিল মেটাতে পারছেন না। কাজিরাঙায় সাফারি বাতিল করে বোকাখাতের এটিএমে সকাল থেকে লাইন দিতে হয়েছে অনেককে। গণেশগুড়ির ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে টাকা ভাঙাতে এসে বিপদে পড়া তাইল্যান্ডের পর্যটকদের পকেট থেকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেন ম্যানেজার। অন্য এক গ্রাহক তাঁদের কাছ থেকে পুরনো ৫০০ টাকা নিয়ে ভাঙিয়ে দেন। কিন্তু সর্বত্র এমন সহৃদয় ম্যানেজার বা সাহায্যকারী মেলে না।

শীত পড়লেই নেপাল থেকে হাইলাকান্দি হাজির হন শিরিং গুরুং। তিন দশক ধরে প্রতি বছর আসেন তিনি গরম কাপড় বিক্রি করতে। আজ প্রথম দোকান খোলেন হাইলাকান্দি শহরে। কিন্তু বিকেলের মধ্যেই নোট-সঙ্কটের আঁচ টের পান। অনেক খদ্দের এসেছিলেন। কিন্তু খুচরো টাকার অভাবে বিক্রি হয়নি কার্যত কিছুই। বিকেলে শিরিং বললেন, ‘‘ সকাল থেকে বসে রয়েছি। একটা কিছু বিক্রি হয়নি।’’ তিনি জানান, অনেকে তাঁর দোকানে জিনিস কিনতে এসে পুরনো ৫০০ বা ১ হাজার টাকার নোট ধরাচ্ছেন। কেউ দিচ্ছেন ২ হাজার টাকা। কিন্তু তিনি সে সব নিতে পারছেন না। কবে মিটবে নোট-সঙ্কট— আপাতত একটাই প্রশ্ন ঘুরছে তাঁর মুখে। অন্য দিকে, অসম ও উত্তর-পূর্বে কর ছাড় পাওয়া তফসিল ও পার্বত্য উপজাতিভুক্তদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে কালো টাকা সাদা করার চেষ্টা চলছে বলে আয়কর দফতরের কাছে খবর এসেছে। অসমের ডিমা হাসাও, কার্বি আংলং, বড়োল্যান্ড, মেঘালয়ের খাসি হিল, গারো হিল ও জয়ন্তীয়া হিল, অরুণাচলপ্রদেশ, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ডে উপজাতিভুক্ত ব্যক্তিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আচমকা মোটা টাকার লেনদেন হলেই ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে সতর্ক হতে বলা হয়েছে। ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত এলাকায় থাকা উপজাতিরা আয়কর ছাড় পান। যে কোনও উৎস থেকে আয়ের উপরে তাঁদের কর দিতে হয় না। তাই অসম তথা উত্তর-পূর্বের বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও জঙ্গিরা ওই সব অ্যাকাউন্টগুলি ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকী ভিন রাজ্য থেকেও কালো টাকা সাদা হওয়ার জন্য উত্তর-পূর্বের উপজাতি এলাকায় আসতে পারে বলে খবর।

পুলিশ আগেই জানিয়েছিল, জঙ্গিরা তাদের লিঙ্কম্যান ও ওভারগ্রাউন্ড কর্মীদের সাহায্যে মজুত টাকার পাহাড় সাদা করার চেষ্টা করেছে। শুক্রবার সন্ধেয় এমন তিন লিঙ্কম্যানকে গ্রেফতার করে পূর্ব গারো হিলের পুলিশ। তাদের কাছে মিলেছে প্রায় ৩৬ লক্ষ টাকা। পুলিশের দাবি, ওই টাকা জিএনএলএ প্রধান সোহন ডি শিরার। ধৃত লিংস্টোন মারাকের কাছে সোহনের স্ত্রী ৩৪ লক্ষ ৬৬ হাজার টাকা রেখেছিল। অপর ধৃত লিঙ্কম্যান সিম্পল মোমিনের কাছে মেলে এক লক্ষ ২৫ হাজার টাকা।

গুয়াহাটির বেশিরভাগ এটিএমে শুধু ২০০০ টাকার নোট বেরোচ্ছে। তাই লাইন ক্রমে ছোট হচ্ছে। সাধারণ মানুষ হন্যে হয়ে খুচরো টাকা খুঁজছেন। ব্যাঙ্কগুলির বক্তব্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গত দু’দিন ১০০ টাকার বান্ডিল পাঠাচ্ছে না। কোনওক্রমে ২০ টাকার বান্ডিল দিয়ে মানুষের ক্ষোভ সামলানো হচ্ছে। স্টেট ব্যাঙ্ক ভরসা দিয়েছে, আগামী কালের মধ্যে রাজ্যে এসে পড়বে নতুন ৫০০ টাকার নোট। গুয়াহাটির ১২টি এলাকায় ১২টি এটিএম ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হচ্ছে।

ব্যাঙ্ক সূত্রে খবর, গত আট দিনের হিসেবে (আড়াই লক্ষ টাকা থেকে কম ও বেশি পরিমাণে টাকা জমার হিসেব ধরে) উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন ব্যাঙ্কে জমা পড়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অসমে সর্বাধিক ৩ হাজার ২৮১ কোটি টাকা আট লক্ষ ৪২ হাজার টাকা ৬৭৬টি অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে। মিজোরামে সব চেয়ে কম ৩৩১ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা জমা পড়েছে। শিলংয়ের হাসপাতালগুলিতে ভর্তি থাকা রোগীদের আত্মীয়দের সুবিধায় শিলং জিপিও সব হাসপাতালে মোবাইল ক্যাশ-ভ্যান পাঠাচ্ছে। তারা হাসপাতালের বাইরে রোগীর আত্মীয়দের হাতে থাকা পুরনো নোট বদলে নতুন নোট দিচ্ছে। অবশ্য হাসপাতালের আগাম অনুমতি না নিয়ে হাসপাতাল চত্বরে নোট বিলি করায় শিলং সিভিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জিপিও কর্মীদের কথা কাটাকাটি হয়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জিপিও-র গাড়ি হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। জিপিও জানিয়েছে, অন্য হাসপাতালগুলিতে তাদের পরিষেবা চলবে। সোমবার জিপিওর তরফে গণেশ দাস হাসপাতাল, এইচ গর্ডন রবার্টস হাসপাতাল ও নাজারেথ হাসপাতালে ক্যাশ ভ্যান পাঠানো হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement