কাজ নেই– কাজ চাই। বাজেট ২০১৮-য় কর্মসংস্থানের নতুন দিশা থাকা জরুরি। শুধু সাধারণ মানুষের জন্যই নয়, এই সরকারের টিকে থাকার জন্যও। লাভজনক, সম্মানজনক, স্থিতিশীল, সৃষ্টিশীল, উন্নতমানের কাজ। ১০০ দিনের কাজ অগতির গতি ঠিকই, মরতে মরতে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর বড় সহায়। কিন্তু সে তো বড্ড বেশি সরকারি ব্যাপার। আজ আছে, কাল না-ও থাকতে পারে। বিশেষ করে সরকারি খরচ কমানোর খাঁড়া যখন মাথার উপর ঝুলেই আছে। তা ছাড়া, এতে না আছে যথেষ্ট আয়, না আত্মসম্মান— সৃষ্টিশীলতার প্রায় কোনও প্রশ্নই নেই। একে কি ভাল ভাবে বেঁচে থাকা বলা যায়?
প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাজেট তো মূলত সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসেব। সেখানে মানুষের ভাল ভাবে বেঁচে থাকার প্রশ্ন আসাটা তো গৌণ। কিন্তু যোজনা কমিশনের অনুপস্থিতিতে, নীতি-আয়োগের বার্ষিক পরিকল্পনা ও বার্ষিক বাজেটই তো একমাত্র ভরসা। যেহেতু পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাঠামো আর নেই, উন্নয়নমুখী পরিকল্পনার একটা প্রতিফলন বার্ষিক বাজেটে থাকা দরকার। তাই, কর্মসংস্থান যখন সত্যিই একটা বড় সমস্যা, তখন বাজেটে কাজের দিশা থাকা জরুরি।
ভারতীয় অর্থনীতি যেন একটা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে গেছে। আর্থিক বৃদ্ধির খুড়োর কল থেকে আমরা আর চোখ সরাতেই পারছি না। খানিকটা ‘গ্রোথ’ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কর্মসংস্থান, উন্নতমানের কাজ, তার দেখা পাওয়া ক্রমশ শক্ত হয়ে পড়ছে। হোঁচট খেতে খেতে কর্মসংস্থান একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। নীচের তথ্য অন্তত তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো নোটবন্দি-জিএসটি এ সবের প্রভাবে যে ঠিক কী কী ঘটছে, তা আগামী দিনে প্রকাশিত তথ্যই বলে দেবে।
উপরের সারণী থেকে এটা পরিষ্কার, সংগঠিত ক্ষেত্রে নতুন কাজের সুযোগ খুব তাড়াতাড়ি কমে যাচ্ছে। অন্য দিকে, বিরাট অসংগঠিত ক্ষেত্রের দমবন্ধ করা অবস্থা নীচের তথ্যই বলে দেবে। সে বিষয়ে আমরা একটু পরেই আসছি। আবার, সংগঠিত-অসংগঠিত শিল্প-পরিষেবা আর কৃষি, সব রকমের কাজ মেলালেও দেখা যাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ একেবারে কর্মহীন, নিদারুণ দুর্দশাগ্রস্থ। তাঁদের সংখ্যা এবং হার দুই-ই বেড়ে চলেছে (নীচের সারণী দ্রষ্টব্য)। যেন একটা চোরাবালিতে গিয়ে পড়েছি আমরা। মোদীনমিক্স-এর পরিণতি কি এই? এত শিল্প সম্মেলন– পুঁজি বিনিয়োগ– আর্থিক বৃদ্ধির পিছনে ছোটার পর!
সংগঠিত ক্ষেত্রে সম্মানজনক কাজ নেই। কিন্তু বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছেটা তো আছে। গ্রামে-শহরে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে তাই কেবলই ভিড় করছেন অকৃষি-অসংগঠিত ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কৃষিতে যখন তিল ধারণের জায়গাটুকুও আর নেই। অসংগঠিত ক্ষেত্র অসংখ্য মানুষের বেঁচে থাকার শেষ ভরসা। বড় পুঁজি আর সরকারি ক্ষেত্রের বাইরেই তো বেশির ভাগ মানুষ কাজ করছেন। দেশের মোট উৎপাদনেরও একটা বেশ বড় অংশ আসছে এই অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে। এমনকী বিদেশি মুদ্রাও পাওয়া যাচ্ছে হস্তশিল্পের কল্যাণে। হাতের কাজের চাহিদা বিদেশের বাজারে বাড়ছে বই কমছে না।
আরও পড়ুন: যা ছিল তেরো, হয়ে গেল আঠারো!
অথচ, আমরা এই সব শিল্প-পরিষেবা ক্ষেত্রগুলোকে ঠিক যেন ধর্তব্যের মধ্যেই রাখছি না। আসলে প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতে গরিব মানুষের উন্নয়ন, আর্থিক বৃদ্ধি আর বড় পুঁজি নির্ভর অত্যাধুনিক শিল্পায়ন একেবারে সমার্থক। খেয়ালই রাখছি না যে, বড় পুঁজি-ভিত্তিক বৃদ্ধির পথে অনেক দিন হেঁটেও ন্যুনতম সংগঠিত কাজের সুযোগটুকু নিশ্চিত করা যায় নি। অন্য দিকে, অকৃষি-অসংগঠিত ক্ষেত্র একটা অসম লড়াই লড়েও বেঁচে আছে।
উপরের সারণী দুটো গুরুত্বপূর্ণ। দেখতে পাচ্ছি, বহু কোটি মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আমরা মনে করি শহর মানেই আধুনিক জীবন– বড় বড় সংগঠিত কলকারখানা– উচ্চমার্গের অফিসকাছারি। অথচ সেই শহরেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তন বেশি, যদিও দেশের বেশির ভাগ মানুষ আজও গ্রামে থাকেন। অন্য দিকে, দ্বিতীয় সারণীটা বেদনাদায়ক। যৎসামান্য শ্রমিকদের মাথাপিছু মজুরি। বার্ষিক মাথাপিছু মুল্যযোগও খুবই কম (মুল্যযোগ হল মোট আয়ের থেকে কাঁচামালের খরচ, বিদ্যুৎ বিল, পরিবহণ খরচ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, নানান কর, কমিশন ইত্যাদি বাদ দিয়ে যা পড়ে থাকে মালিকের লাভ, শ্রমিককে দেয় মজুরি, জমি বা বাড়ির ভাড়া এবং দেয় সুদ বাবদ)। বিচিত্র ব্যাপার হল, মালিক-শ্রমিক দুইয়ের অবস্থাই সঙ্গিন। তা হলে, অত্যাধুনিক শিল্পায়ন নির্ভর আর্থিক বৃদ্ধির ঢক্কানিনাদের মানে কি? অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই করুণ অবস্থা আর অন্য দিকে কৃষি সঙ্কট, চাষিদের আত্মহত্যা।
আর্থিক বৃদ্ধির চেনা পথ ছেড়ে তাই একটু অন্য কথা ভাবা দরকার। এমন অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ, যেখানে কর্মসংস্থান থাকবে সব হিসেবের কেন্দ্রে। অত্যাধুনিকতার ঝোঁকের বদলে শ্রমনিবিড় শিল্পায়ন নিয়ে সত্যিকারের চিন্তাভাবনা চাই। বড় বা বিদেশি পুঁজিকে তোয়াজ করা এসইজেড-এর তর্জন-গর্জনের বাইরে গিয়ে কোটি কোটি অসংগঠিত উৎপাদককে কী ভাবে যূথবদ্ধ করা যায় সেটাই মূল কথা। কারণ, এক জায়গায় জড়ো হলে তবেই তাঁরা বড় পুঁজির সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবেন। সার্বিক স্ব-ক্ষমতা অর্জনের সেটা একটা বড় উপায়। একত্রিত থাকলে শুধু বড় পুঁজির সাথে দরকষাকষিতেই নয়— পরিকাঠামো, মূলধন, কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, শ্রম, কাজের বরাত, প্রযুক্তি, নকশা, বাজার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ— সব কিছুতেই সুবিধা পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র উৎপাদক ও ব্যবসায়ী হয়েও একসঙ্গে থেকে নিবিড় যোগাযোগ ও আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে বড় পুঁজির চরিত্রগত সুবিধাগুলো অর্জন করা যায়।
বহু অসংগঠিত শিল্পোৎপাদন শত শত বছর ধরেই একত্রিত (ধনেখালি-তাঁতিপাড়ার তাঁত, তিরুপুরের হোসিয়ারি, বারাণসীর বেনারসী, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল, সুরুলের কাঁথার কাজ এমন আর-ও অনেক)। এঁদের উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন। উৎপাদনের উপকরণ, প্রযুক্তি, কাঁচামাল, বাজার, মূলধন, পরিকাঠামো, সব রকমের সাহায্যই চাই। এঁরা যাতে বড় পুঁজি ও মহাজনদের দৌরাত্ম্য থেকে বেরিয়ে এসে, বড় পুঁজির সাথে টক্কর দিয়ে দেশ-বিদেশের বাজারে পুরনো গৌরব ফিরে পান, সেটা দেখা দরকার। না হলে চিনের নকল বেনারসী কিংবা মাটির পুতুল, কোরিয়া-তসর, এ সবে দেশ-বিদেশ ছেয়ে যাবে। আর আমাদের ‘শিল্পী’রা নিঃস্ব হয়ে যাবেন। এটাই তো স্বাভাবিক।
অন্য দিকে যারা যূথবদ্ধ নন– যে সমস্ত অসংগঠিত উৎপাদক তুলনামূলকভাবে নতুন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন সমস্ত দেশজুড়ে (খুচরো ব্যবসায়ী, ফেরিওয়ালা, মোটর মেকানিক, লেদ মেশিনের মালিক-শ্রমিক, কাঠ-মিস্ত্রি, লোহা-লক্করের কর্মী, এমন হাজারও ব্যবসা), তাঁদের কী ভাবে এক-একটা ছাতার তলায় আনা যায় সেটা ভাবা জরুরি। সুষ্ঠু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা চাই, যাতে গ্রাম-শহরে স্থিতিশীলভাবে এক-একটা ছোট ব্যবসার বিগবাজার আর ছোট উৎপাদকের এসইজেড তৈরি হয়। তা হলেই এঁরা অর্জন করতে পারবেন স্ব-ক্ষমতা। তবে এর জন্য দৃষ্টিভঙ্গির একটা বড় বদল জরুরি।
এই ক্লাস্টার-ভিত্তিক উন্নয়ন-ভাবনা নতুন কিছু নয়। দেশে-বিদেশে এ-নিয়ে চর্চা হয়েছে, হচ্ছেও। সরকারি রিপোর্টেও এ সব দেখতে পাওয়া যাবে। অথচ, ঠিক যেন ভরসা নেই এই বিকল্প পথটার উপর, কিংবা বড়-পুঁজির সর্বব্যাপী প্রভাবেই হয়তো এ সব চলে যাচ্ছে ফুটনোট বা পিছনের পাতায়। কিন্তু, আমরা সত্যিই যদি একটা সার্বিক উন্নয়নের পথে হাঁটতে চাই, যদি সততার সঙ্গে সত্যিই চাই ‘সবকা সাথ/সবকা বিকাশ’, তবে এই বিকল্প পথটাকেই বেছে নিতে হবে।
যোজনা কমিশনের তল্পিতল্পা গোটানোর পর যেহেতু বার্ষিক পরিকল্পনা ও বার্ষিক বাজেট-ই ভরসা, এই বাজেটেই দেখতে চাইব একটা বড় বদল। বিশেষ করে যখন কাজ কমে যাচ্ছে দেশজুড়ে। নোটবন্দি ও জিএসটি-র ফাঁসে হাঁসফাঁস করছেন ছোট ছোট উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা। ঠিক সেই সময়ে ক্লাস্টার-ভিত্তিক উন্নয়ন-ভাবনাকে বাজেট বক্তৃতার একেবারে প্রথম পাতায় দেখতে পেলে স্বস্তি হবে খানিকটা। নিদেনপক্ষে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো, বিশেষ-অর্থনৈতিক-অঞ্চল, মূলধন, বাজার, প্রযুক্তি ইত্যাদি সংক্রান্ত নির্দিষ্ট প্রস্তাব বাজেটে থাকা নিতান্তই প্রয়োজন।
গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ