দিল্লির রাস্তায় পোড়ানো হচ্ছে বাজি। ছবি: পিটিআই।
ছ’মাস আগের ঘটনা। দেশের প্রথম চোদ্দো লেনের হাইওয়ে উদ্বোধনে গিয়ে সে দিন খোলা জিপে ২৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপর দিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
গত কাল রাতে সেই সড়কের উপর বাজি পোড়ানোর জন্য বেঁধে দেওয়া সময়সীমা (আটটা থেকে দশটা) পেরিয়ে যাওয়ার অনেক পরে, প্রায় মধ্যরাতে এসে দাঁড়ালো দু’-তিনটি জিপ। ধোঁয়াশায় তিন ফুটের দূরত্বও তখন অস্পষ্ট। স্বচ্ছ ভারতের ধ্বজাধারী ঝাঁ চকচকে ওই হাইওয়ের জেব্রা ডিভাইডারের উপর সার দিয়ে বসানো হল তুবড়ি, রকেট এবং আরও কিছু শব্দবাজি। ধোঁয়া এবং শব্দের তাণ্ডব চলল আধ ঘণ্টা ধরে। সঙ্গে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি!
এটি একটি খণ্ড দৃশ্য। কিন্তু দিল্লিতে দীপাবলির রাতের একটি চুম্বক দৃশ্যও বটে। আইনের শাসনকে কার্যত কাঁচকলা দেখিয়ে রাজধানী এবং সংলগ্ন অঞ্চলে দেওয়ালির মধ্যরাত পর্যন্ত দেদার পুড়েছে বাজি। তার পরের দিন এই খবর লেখা পর্যন্ত গোটা শহর ডুবে রয়েছে ঘন ধোঁয়াশায়। বৃহস্পতিবার সকাল ন’টায় রাজধানীতে বায়ুর গুণগত সূচক ছাপিয়ে গিয়েছে বিপদমাত্রার সর্বোচ্চ সীমা (৯৯৯)! যেখানে এর স্বাভাবিক মান হওয়া উচিত ৫০। দম আটকানো পরিস্থিতি। গুরুগ্রাম, নয়ডা এবং গাজিয়াবাদের পরিস্থিতি আরও খারাপ। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ রামের নামে বাজি পোড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন! সর্বোচ্চ আদালতকে উপেক্ষা করেই তাঁর অনুগামীরা উত্তরপ্রদেশ লাগোয়া এলাকায় বুধবার দেদার বাজি পুড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নিষিদ্ধ বাজি এবং রামের নামে জয়ধ্বনি— দুই-ই চলেছে পাল্লা দিয়ে!
যে ভাবে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করে দেদার বাজি পোড়ানো হল, যে ভাবে দেশের রাজধানী গ্যাসচেম্বারে পরিণত হল, তাতে প্রশ্ন উঠেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়েও। অনেকেই বলছেন, আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে এটি একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। গোটা ঘটনায় সব মহলের প্রশ্নচিহ্নের মুখে কেন্দ্রের শাসক দল। কারণ দিল্লি পুলিশ তাদেরই নিয়ন্ত্রণে। আর মোদীর দলের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিল্লি পুলিশ নিজেদের ব্যর্থতা এক রকম মেনে নিয়ে জানিয়েছে, গত কাল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি।
ক’দিন আগেই জেনিভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’-এর পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক দূষণ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। তাতে বায়ু দূষণের প্রশ্নে বিশ্বের প্রথম কুড়িটি শহরের মধ্যে ১৪টিই ভারতের! শুধু দিল্লি নয়, বারাণসী, কানপুর, আগরা, মুজফ্ফরপুর, জোধপুর, ফরিদাবাদের মতো শহর রয়েছে এই তালিকায়। ঘটনাচক্রে সবক’টি রাজ্যই বিজেপি-শাসিত। এবং সর্বত্রই শীর্ষ আদালতের রায়কে গত কাল উপেক্ষা করা হয়েছে। নিশানায় মোদী নিজেও। ক’দিন আগেই আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে মোদী বায়ু দূষণ এবং উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে সামগ্রিক লড়াইয়ের কথা বলেছেন। ১৪ নভেম্বর তিনি সিঙ্গাপুরে যাবেন আসিয়ান সম্মেলনে। সেখানেও আলোচ্যসূচিতে দূষণ অগ্রাধিকার পেতে চলেছে। মোদী তথা বিজেপির অস্বস্তি বাড়িয়েছে আরও একটি তথ্য। চলতি বছরে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যৌথ ভাবে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ সংক্রান্ত শীর্ষ খেতাব পেয়েছেন মোদী।
কিন্তু এ সব তথ্য-খেতাবে আদতে কী লাভ হল? দীপাবলির ক’দিন আগে থেকেই বিপজ্জনক ভাবে দূষিত হচ্ছিল দিল্লির বাতাস। হু-এর নির্ধারিত মাত্রার কুড়ি গুণ দূষিত হয়ে উঠেছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, যে বাজিগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলি যাতে বিক্রি না হয়, তা পুলিশ-প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে। যে সব অঞ্চলে বেআইনি ভাবে বাজি বিক্রি হবে, সেখানকার পুলিশ স্টেশনের এসএইচও-কে দায় নিতে হবে। কিন্তু বুধবার রাতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করার ভুরি ভুরি অভিযোগ এসেছে দিল্লির সব প্রান্ত থেকে। দিল্লি লাগোয়া এলাকাগুলি থেকেও।