জাপোরিজিয়া পরমাণু কেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ড ছবি: রয়টার্স
বিশেষজ্ঞেরা এই ভয়টাই সব সময় পান!
খবরে দেখলাম, ইউক্রেনের জ়াপোরিজিয়া পরমাণু চুল্লিতে আগুন। সেই আগুন রুশ সেনাদের আক্রমণের ফল। পরমাণু চুল্লির কোথায় আগুন, তা অবশ্য বলা হয়নি খবরে। তবে ইউরোপের সব থেকে বড় ওই পরমাণু চুল্লিতে যে কোনও সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তেমন হলে, কত মানুষ যে তাতে মারা যাবেন, তার ইয়ত্তা নেই। এটাই পরমাণু চুল্লির বড়সড় বিপদ।
যুদ্ধ বাধলে আক্রমণকারী দেশের পক্ষে আক্রান্ত দেশে পরমাণু বোমা না ফেলেও অনেকটা মানুষ মেরে এবং অট্টালিকা উড়িয়ে দিয়ে ক্ষতি করা যায়। আবার যুদ্ধ না বাধলেও, মানুষের গাফিলতিতে পরমাণু চুল্লিতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল যেমন ঘটেছিল এই ইউক্রেনেরই (তৎকালীন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য) চের্নোবিলে। ওই ঘটনায় ১৮০০ কোটি রুবল ক্ষতি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের। চের্নোবিল কাণ্ডে এ পর্যন্ত তেজস্ক্রিয়তায় মারা গিয়েছেন কয়েকশো মানুষ।
পরমাণু চুল্লিতে দুর্ঘটনার খতিয়ান আরও আছে। ২০১১ সালের ১১ মার্চ ভূমিকম্প এবং সুনামির ফলে জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু চুল্লিতে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে অবশ্য দুর্ঘটনার মাত্রা চের্নোবিলের মতো মারাত্মক নয়। ১৯৭৯ সালের ২৮ মার্চ আমেরিকার পেনসিলভ্যানিয়া প্রদেশের থ্রি মাইল আইল্যান্ডের পরমাণু চুল্লিতেও দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
মনে রাখতে হবে, পরমাণু চুল্লি এবং পরমাণু বোমার মূল নীতি একই। ১৯০৫ সালে আবিষ্কৃত আলবার্ট আইনস্টাইনের ‘ই ইকুয়ালস টু এমসি স্কোয়ার’ সূত্র অনুযায়ী, শক্তি এবং পদার্থ, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পার্থক্য শুধু, পরমাণু চুল্লিতে যে কাজটা হয় তিলে-তিলে, সেই কাজটাই পরমাণু বোমা করে এক লহমায়। আসলে পরমাণু চুল্লি বা পরমাণু বোমার কাজ পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা। ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়ামের ভারী পরমাণুকে নিউট্রন কণা দিয়ে আঘাত করলে যে দু’টি হালকা পরমাণু পাওয়া যায়, সে দুটি পরমাণুর ভর ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের পরমাণুর থেকে কম। অর্থাৎ, নিউট্রন কণা দিয়ে আঘাত করলে কিছুটা পদার্থ হারিয়ে-যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া পদার্থ শক্তি বা এনার্জি (তাপ, ধাক্কা) হিসাবে প্রতিভাত হয়। যেহেতু আইনস্টাইনের সূত্রের মধ্যে আলোর বেগের (সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার) বর্গ মজুত আছে তাই একরত্তি পদার্থ মানে বিপুল পরিমাণ শক্তি।
এ বার আসি, পরমাণু চুল্লির সব থেকে বড় বিপদের কথায়। কোর মেল্টডাউন বা জ্বালানি বিপর্যয়। পরমাণু চুল্লি থেকে তিলে-তিলে শক্তি পেতে তাপ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় লাগাম পরানো হয়। অর্থাৎ তেজস্ক্রিয় জ্বালানির উপরে নিয়ন্ত্রিত ভাবে নিউট্রন কণা আঘাত হানে। পরমাণু চুল্লিতে এ কারণেই তাপ কমানোর নানা ব্যবস্থাও থাকে। কোনও কারণে তাপে লাগাম পরানোর পদ্ধতি বিগড়ে গেলে দুর্ঘটনা ঘটে। সেটাই হয়েছিল চের্নোবিলে, ফুকুশিমায় এবং থ্রি মাইল আইল্যান্ডে।
পরমাণু বোমা ফাটলে বা চুল্লি ভেঙে গেলে তেজস্ক্রিয়তা মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। কারণ, ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়াম পরমাণুকে নিউট্রন কণা দিয়ে আঘাত করলে যে দু’টি হালকা পরমাণু পাওয়া যায়, তারা হাজার-হাজার বছর ধরে তেজস্ক্রিয় থাকে। তাই চুল্লিতে উৎপন্ন হালকা পরমাণুগুলিকে (বর্জ্য জ্বালানি) বিভিন্ন ধরনের কুঠুরি বা চেম্বারে সুরক্ষিত রাখতে হয়। এই প্রক্রিয়াও কম বিপজ্জনক নয়। যুদ্ধের সময় আক্রান্ত দেশের পক্ষে আক্রমণকারী দেশের হানা থেকে এগুলি বাঁচানো কঠিন।
বিংশ শতকে এক সময় পরমাণু বোমা তৈরি নিয়ে ঘোরতর সংশয় ছিল খোদ আইনস্টাইনেরই। পরমাণু বোমা তৈরি কতটা সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তরে আইনস্টাইন বলেছিলেন, “যে জঙ্গলে পাখি কম, সেখানে রাতের বেলায় পাখি শিকারের মতোই।” অর্থাৎ, সম্ভাবনা খুবই কম। সেই আইনস্টাইনই হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী লিয়ো সালার্ড-এর প্ররোচনায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন বিলানো রুজ়ভেল্টকে চিঠি লিখে বলেছিলেন, “জার্মানি মনে হচ্ছে পরমাণু বোমার দিকে এগোচ্ছে। তার আগে আমেরিকার সে বোমা বানানো উচিত।” রুজ়ভেল্ট যে আইনস্টাইনের চিঠি পেয়েই পরমাণু বোমা তৈরি করতে নামেন, এমন নয়। তিনি দেখেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যে দিকে এগোচ্ছে তাতে আমেরিকার ওই বোমা বানানোই উচিত। জাপানের হিরোশিমা, নাগাসাকিতে সেই পরমাণু বোমা ফেলেই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই ঘটনার পরে জাপানি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হিদেচি ইউকাওয়ার কাছে কেঁদে ফেলেছিলেন আইনস্টাইন।
পরমাণু চুল্লিতে এখন যে ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, সে পদ্ধতির নাম ফিশন। অর্থাৎ, ভারী পরমাণুকে ভেঙে দু’টুকরো করা। অন্য পথেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। সে পদ্ধতির নাম ফিউশন। হাল্কা পরমাণুগুলিকে জোড়া দিয়ে নক্ষত্র যে ভাবে আলো, তাপ দেয়। ফিউশনে ফিশনের মতো তেজস্ক্রিয়তার বিপদ নেই। তাই ইউরোপ, আমেরিকার বিজ্ঞানীরা চার দশক ধরে ফিউশন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা করছেন।
চেষ্টা তো করছেন, কিন্তু ফল পাওয়া যাচ্ছে কই!