রাজনাথ সিংহ। —ফাইল চিত্র।
জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যের পরে অসম জুড়ে তোলপাড়। সেই আঁচ গিয়ে লাগল সংসদেও। শুধু তা-ই নয়, অসমে তিনটি এফআইআর দায়ের হল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে!
বুধবার বীরভূমের জনসভায় অসম পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি মমতা পরোক্ষে অসম ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, বাঙালিদের গায়ে হাত পড়লে তিনি ছেড়ে কথা বলবেন না। দলকে বিষয়টি নিয়ে সংসদে সরব হওয়ারও নির্দেশ দেন তিনি। সেই মতো আজ সকালে সংসদ চত্বরে গাঁধীমূর্তির পাদদেশে বিক্ষোভ দেখান তৃণমূল সাংসদরা। স্লোগান ওঠে, ‘অসম থেকে বাঙালি খেদাও মানছি না মানব না।’ এর পর লোকসভার জিরো আওয়ারে বিষয়টি নিয়ে সরব হন সৌগত রায়। তিনি বলেন, ‘‘১ কোটি ৩৯ লাখ মানুষের নাম বাদ গিয়েছে যার মধ্যে অধিকাংশই বাঙালি। আমরা ভয় পাচ্ছি যে অসম থেকে বাঙালিদের তাড়ানোর জন্য ষড়যন্ত্র রচনা হচ্ছে।’’ তাঁকে সমর্থন জানান, কংগ্রেস, সিপিএম-সহ অন্য বিরোধী দলগুলি।
পরিস্থিতি সামাল দিতে উঠে দাঁড়ান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। অসমে বাঙালিদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না বলে আশ্বাস দেওয়ার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি। রাজনাথ বলেন, ‘‘নাগরিকপঞ্জির যে খসড়া প্রকাশিত হয়েছে, তা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই হয়েছে। যাঁদের নাম বাদ গিয়েছে তাঁরা ট্রাইবুনালে যেতে পারেন।’’
পরে সৌগতবাবুর সঙ্গে আলাদা করে বৈঠকও করেন রাজনাথ। সূত্রের খবর, তৃণমূল সাংসদকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন আতঙ্কের কোনও কারণ নেই। এনআরসি-র এই খসড়াই চূড়ান্ত নয়। এর পরেও একাধিক খসড়া বের হবে। তার পরেও যদি কারও নাম না থাকে, তা হলে তিনি ট্রাইবুনালের কাছে যেতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হল, স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে কেন বিবৃতি দিতে গেলেন রাজনাথ? কেনই বা আলাদা কথা বললেন সৌগতবাবুর সঙ্গে? এর আগে কংগ্রেস যখন সংসদ ও সংসদের বাইরে বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছিল, তখন তো কেন্দ্র বিন্দুমাত্র আমল দেয়নি! দিল্লির রাজনীতিকদের কেউ কেউ বলছেন, এর পিছনে রাজনাথ-মমতা ব্যক্তিগত সখ্য কাজ করেছে।
কেউ কেউ আবার এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের মতে, মমতার গত কালের মন্তব্যে অসমে বিপুল বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সে রাজ্যের বাঙালিদের মধ্যেও আড়াআড়ি বিভাজন হয়ে গিয়েছে। বরাকের বাঙালিরা খুশি হলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা অস্বস্তিতে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সূত্রেরও দাবি, মমতার মন্তব্যের জেরে অসমের বাঙালিরা কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারেন। অসম সরকারের পক্ষ থেকেও মন্ত্রককে জানানো হয়েছে, এই ধরনের মন্তব্যের ফলে জাতি দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কোনও কোনও সূত্রের মতে, সেই কারণেই রাজনাথ লোকসভায় বিবৃতি দিয়েছেন এবং সৌগতবাবুকে ব্যক্তিগত ভাবে বাক্সংযমের বার্তা দিয়েছেন।
বস্তুত মমতার গত কালের মন্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের অবমাননা এবং জাতিবিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছে বলে আজ একাধিক অভিযোগ দায়ের হয়েছে অসমে। লতাশিল থানায় দায়ের হয়েছে দু’টি অভিযোগ। একটি দায়ের করেছেন বিজেপি নেতা তথা আইনজীবী বিজন মহাজনের নেতৃত্বে কয়েক জন আইনজীবী। দ্বিতীয় অভিযোগটি দায়ের করেছেন অসম প্রদেশ তৃণমূলের প্রাক্তন প্রধান মুখপাত্র কৈলাস শর্মা। কৃষক শ্রমিক কল্যাণ পরিষদের পক্ষেও দিসপুর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ তিনটি অভিযোগই গ্রহণ করে এফআইআর রুজু করেছে।
তবে এ সব সত্ত্বেও তিনি যে মুখ বন্ধ করবেন না, তা এ দিন স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘এক কোটিরও বেশি মানুষকে যদি বৈধ নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে কি আমি মুখ খুলব না? বারবার বলব, একশো বার বলব। এত মানুষ কোথায় যাবে?’’ উত্তরে বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের অভিযোগ, ‘‘বাংলাদেশ থেকে অবৈধ ভাবে আসা লোকেদের পশ্চিমবঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হচ্ছে। শ্লীলতাহানি-সহ বিভিন্ন অভিযোগে তাদের নাম জড়াচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগে নিজের রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা সামলান।’’