Few steps by Central Government

ভাল পণ্যের লোভে ফের চোরাবাজারের শরণে যাবে না তো দেশ!

বিদেশে তৈরি জামাকাপড়, রেকর্ড প্লেয়ার থেকে শুরু করে হরেকরকম্বা। আর ফেরার সময় দার্জিলিং মেলে সাবধানে লুকিয়ে সে সব আনা। না হলে পুলিশ ধরবে যে!

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২০ ১৯:৪১
Share:

লাইসেন্সরাজ ভারতের ক্রেতাদের কাছ থেকে ভাল পণ্যের স্বাদ কেড়ে নিয়েছিল। ফাইল চিত্র।

আবার কি সেই লাইসেন্স রাজ ফিরছে? আবার আগের মতো রমরম করবে চোরা বাজার? হঠাৎ‌ করে কেন এই সংশয়? কেন সংশয় সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, ফিরি বছর তিরিশ আগের কথায়।

Advertisement

আজকের প্রজন্ম ভাবতেই পারবে না সেই যুগের কথা। শিলিগুড়ি দিয়ে উত্তরবঙ্গে কোথাও ঘুরতে গেলে, নেপাল সীমান্তে ধুলাবাড়ি দর্শন না করলে বাঙালির সে ভ্রমণ সম্পূর্ণ হত না। বিদেশে তৈরি জামাকাপড়, রেকর্ড প্লেয়ার থেকে শুরু করে হরেকরকম্বা। আর ফেরার সময় দার্জিলিং মেলে সাবধানে লুকিয়ে সে সব আনা। না হলে পুলিশ ধরবে যে!

সেই লাইসেন্স রাজের জামানায়, আজ যা আমাদের কাছে সহজলভ্য, তখন তা ছিল দুর্লভ। ১৯৯০ সালের আগে তাই বিদেশ থেকে আত্মীয় স্বজন এলে বাড়িতে সবাই মুখিয়ে থাকত উপহারের জন্য। আমাদের এখানে তখন জিন্‌স-এর মতো সূতির প্যান্টও ছিল অধরা, যা আজ সকলের কাছেই সহজলভ্য।

Advertisement

প্রতিযোগিতার জোয়ার না থাকায়, কোনও সংস্থারই বিশ্বমানের পণ্য তৈরির তাগিদ ছিল না। আমরা ক্রেতারা জানতামই না ভাল মানে ঠিক কতটা ভাল। ফাইল চিত্র।

ভারত গড়তে সরকার যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে বিনিয়োগ করেছিল, ঠিক তেমনই দেশের শিল্পকে বাঁচাতে বিদেশি পণ্যের আমদানি হয় বিরাট হারে শুল্ক বসিয়ে, না হয় সরাসরি আমদানি বন্ধ করে এক আত্মনির্ভর ভারত গড়ার রাস্তায় হাঁটার চেষ্টা করেছিল স্বাধীনতার পরে তিন দশক ধরে। তার ফল? যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে, ভারতে তখন এমনকি রান্নাঘরে ব্যবহার করার ভাল ছুড়িও বাজারে মিলত না। যাঁদের আত্মীয় বিদেশে থাকতেন না, তাঁরা জানতেনই না, কী জাতীয় নিকৃষ্ট পণ্য নিয়ে তাঁরা খুশি থাকছেন!

আরও পড়ুন: ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর পরিস্থিতি কী ভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করছে বেইরুট

এ রকম নয় যে, ৬০ থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত ভারতের পরিকল্পিত অর্থনীতিতে যা হয়েছে সবই খারাপ। তৎকালীন প্রেক্ষিতও ছিল ভিন্ন। কিন্তু এটাও ঠিক যে, লাইসেন্সরাজ ভারতের ক্রেতাদের কাছ থেকে ভাল পণ্যের স্বাদ কেড়ে নিয়েছিল। বাজারে প্রতিযোগিতার জোয়ার না থাকায়, কোনও সংস্থারই বিশ্বমানের পণ্য তৈরির তাগিদ ছিল না। কারণ, আমরা ক্রেতারা জানতামই না ভাল মানে ঠিক কতটা ভাল। তাই বাজারে যা মিলত তাই নিতাম শেষ কথা মেনে নিয়েই।

এই প্রসঙ্গে একজনের কথা মনে পড়ল। তরুণ বয়সে তিনি দেশের অন্যতম টেবিল টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন। এখন প্রথিতযশা উদ্যোগপতি। একদিন কথায় কথায় বলছিলেন, “যখন বিদেশি ব্যাটগুলো দেখতাম, খুব লোভ হত। কিন্তু টাকা ছিল না। বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে লড়ার সময় দেশি ব্যাট শানিয়েই নামতাম। ওদের ওই দারুন ব্যাট হাতে থাকলে আরও সহজ হত আমার লড়াই!”

ভারতে তখন খেলার সরঞ্জাম আমদানির উপর নিষেধাঞ্জা ছিল, যেমন ছিল আরও কয়েক লক্ষ পণ্যের উপর। আজকের খেলোয়াররা যা সহজেই পায়, সে জামানায় আমাদের খেলোয়ারদের তা হাতে পেতে কালঘাম ঝরে যেত। আবার কি সেই দিন ফিরছে? আত্মনির্ভর ভারতের গতি নির্ধারণের যে দিশা দেখা যাচ্ছে, তাতে সম্ভবত খুব তাড়াতাড়িই এই নিষেধাজ্ঞার বলি হবে খেলার সরজ্ঞাম বা আসবাবপত্র। টায়ার, টেলিভিশন তো ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেই গিয়েছে।

চোরা পথে বিদেশি মাল আসত। দেশে তৈরির পণ্যের থেকে তার গুণগত মানও ছিল অনেক ভাল। ফাইল চিত্র।

সমস্যাটা এখানেই। একদিকে আমরা গরিবের হাতে সরাসরি ভর্তুকি পৌঁছিয়ে দেওয়ার কথা বলছি। পৌঁছিয়ে দেওয়ার পরিষেবা বা তাঁদের সেই পরিষেবা ব্যবহারের ক্ষমতা যাই হোক না কেন। আমরা বলছি পরিষেবার দাম নিয়ন্ত্রণ করলে বাজারের লেনদেন ঠিক মতো হয় না। কিন্তু আমদানি নীতিতে ঠিক উল্টো রাস্তায় হাঁটছি, বাজার যাই বলুক না কেন।

শোনা যাচ্ছে এ সব হচ্ছে আত্মনির্ভর ভারত গড়তেই। কিন্তু কানাঘুষোয় উঠে আসছে এ সব নাকি চিনের বিরুদ্ধে আর্থিক লড়াইয়ের জন্য। আমাদের বাজারের সমস্যা কিন্তু এখানেই। নীতির বৈপরীত্যে। চিন ঠেকাতে আমরা বাজারের পণ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছি। তার মানে দাঁড়াচ্ছে একটাই। বাজারের চাহিদা নয়, আমরা নির্ধারণ করতে চাইছি ক্রেতাদের পছন্দকেই।

ব্যাপারটা বুঝতে একটু এগোন যাক। সরকার টেলিভিশনকে নিয়ন্ত্রিত আমদানির তালিকায় নিয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ টেলিভিশন সেট আমদানি করতে গেলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। সরকার তার নীতির জায়গা থেকে আমদানির অনুমতি দেবে। চিনের সঙ্গে আজ আমাদের বিবাদ। তাই চিনের কাছ থেকে এই আমদানি কালো তালিকাতেই থাকবে। তা থাকুক। কিন্তু কোথাও বলা নেই এই নিয়ন্ত্রিত আমদানির তালিকায় টেলিভিশন কত দিন থাকবে। চিনের সঙ্গে বিবাদ মিটলে কি টেলিভিশন আবার ফিরবে অনিয়ন্ত্রিত আমদানির তালিকায়?

সমস্যাটা চিন থেকে আমদানি বন্ধ করা নিয়ে নয়। সমস্যাটা হল, এই আমদানি বন্ধের রাস্তায় কী ভাবে হাঁটতে চলেছি আমরা। আর আমাদের অর্থনীতির উপর তার অভিঘাত নিয়ে। ধুলাবাড়ি দিয়ে প্রসঙ্গ শুরু করেছিলাম। নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি যা করে, তখন তাই হয়েছিল। কালোবাজারির রমরমা। চোরা পথে বিদেশি মাল আসত। দেশে তৈরির পণ্যের থেকে তার গুণগত মানও ছিল অনেক ভাল।

আরও পড়ুন: রামমন্দিরে চাপা পড়ল ৩৭০ বিলোপের বর্ষপূর্তি, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় উপত্যকা

আর সমস্যাটা এখানেই। চিন থেকে আমদানি বন্ধ হোক। কিন্তু লাইসেন্সরাজ এলে তো সেই নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির জমানায় আমরা ফেরার রাস্তা তৈরি করছি। সেই জমানা, যখন দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ছিল আড়াই থেকে তিন শতাংশ। ব্যবসা করতে অনুমতির পাহাড় লাগত। আর তাই মানুষ বিনিয়োগের রাস্তায় হাঁটতে ১০০ বার ভাবত। বাজারে প্রতিযোগিতা ছিল না। আর উৎপাদকদের চাপও ছিল না নানান নতুন পণ্য তৈরি করায়। আমাদের পণ্যও বিদেশের বাজারে ব্রাত্য ছিল শুধু গুণমানের কারণেই। যে জামানাকে আমরা উঠতে বসতে সমালোচনা করছি, সেই জমানাকেই আবার আঁকড়ে ধরে ক্রেতার কী কেনা উচিত তা বলার চেষ্টা কিন্তু বাজার অর্থনীতির বিপরীতেই হাঁটা। কারণ, তা যে ক্রেতার অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে। তার পছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে। বাজার গণতন্ত্রের মূল স্রোত যে এর উল্টো। আর ইতিহাস বলে এতে কালোবাজারই উৎসাহ পায় হইহই করে বাড়ায়। চিন ব্রাত্য। মানলাম। কিন্তু আমাদের বিশ্বমানের পণ্য কেনার অধিকার রক্ষা পাবে তো?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement