খরার রাজ্যে

ঘরের পুরুষটি কি বাঁচবে, বলবে আকাশ

পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ৪৫ শতাংশই খরার কবলে। জলের কাছে বন্ধক জীবন কাটছে কী ভাবে? পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ৪৫ শতাংশই খরার কবলে। জলের কাছে বন্ধক জীবন কাটছে কী ভাবে?

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৯ ০২:৩৩
Share:

আত্মঘাতী চাষি পরশুরামের দুই ছেলে। করমগাঁওয়ে। নিজস্ব চিত্র

গরম পড়লেই বুক কাঁপে করমগাঁওয়ের পরশুরাম ঝাড়ের পরিবারের দুই পুত্রবধূর। চাষের মরসুম মানেই ঘরে যা সোনা আছে, তা মহাজনের কাছে বন্ধক পড়বে। সেই সোনা ফিরে পেতে তাকিয়ে থাকতে হবে আকাশের দিকে!

Advertisement

গয়না তো পরের কথা, এক বেলাও খাওয়া জুটবে কি না, এমনকি, ঘরের পুরুষটি বেঁচে থাকবে কি না, তা-ও বলে দেবে আকাশ।

কারণ, বিদর্ভ মানেই বছর বছর খরা। শস্যের এবং চাষির দফারফা। ঋণের দায়ে কৃষকের আত্মহত্যা।

Advertisement

মহারাষ্ট্রের এই অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে জানা গেল, বিদর্ভের ছোট, মাঝারি চাষিরা মরসুমের শুরুতেই ঋণ নিয়ে চাষের কাজ শুরু করেন। ফসল ভাল হলে ঋণ শোধ করতে পারেন। তা না-হলে বোঝা বাড়তেই থাকে। অমরাবতী জেলার করমগাঁওয়ের পরশুরাম ঝাড়ে এ ভাবেই প্রায় দেড় লক্ষ টাকার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়েছিলেন। তার পর ২০১৪-র এক ভোরে খেতের পাশে গাছে তাঁর দেহ ঝুলল। ছেলে রাজু বলছেন, ‘‘ঋণের বোঝা সামলাতে পারবে না জেনেই বাবা ওই কাজ করেছিল। সেই নিয়ে হইচই হওয়ার পর ঋণ মাফ হয়েছে।’’

এখনও পৈতৃক চার একর জমিতে সয়াবিন চাষ করেন রাজু ও ভাই কৈলাস। কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে ‘অজানা’ কারণে ঋণ মেলে না। তাই সোনা বন্ধক রেখেই ঋণ নেন। ফসল উঠলে ছাড়িয়ে আনেন। কিন্তু গত কয়েক বছর তো ভাল ফসল হয়নি, দামও মেলেনি! কৈলাস বলেন, ‘‘বৌ, বাচ্চা নিয়ে আধপেটা খেয়ে থাকতে হয়। কিন্তু ওইটুকু সোনা না ছাড়িয়ে আনলে পরের বছর চাষ করব কী ভাবে?’’ তাঁরা জানান, এক একর জমিতে সয়াবিন চাষ করতে হাজার দশেক টাকা লাগে। চার একরে যা ফসল হয়, ঋণ মিটিয়ে হাতে কিছুই থাকে না। যে বার একটু জল মেলে, সে বার সয়াবিন উঠে যাওয়ার পর গম বা ছোলা চাষ করেন। না-হলে অন্যের জমিতে খাটতে হয়।

আমলাবিষয় গ্রামের কৃষক অনন্ত গণপটেরও ২ একর জমি আছে। তা দিয়ে তো পেট চলে না। শিরদাঁড়ার রোগের জন্য অনন্ত নিজে জমিতে খাটতে পারেন না। পেট চালাতে অনন্তের স্ত্রী অন্যের জমিতে ২০০ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজে যান। ‘‘অন্যের জমিতে না খাটলে কী করব? পেট চলবে কী করে?" প্রশ্ন করেন অনন্তের প্রতিবেশী দেবদাস নিখড়ে। তাঁরও দু একর জমি। তাতে সয়াবিন ফলিয়ে গত দু বছর ধরে লাভ তো হয়নি। বরং কিছুটা গচ্চাই গিয়েছে। তবু এ বছরও জমি চষেছেন তিনি। ফের সয়াবিন ফলাবেন বলে। কেন? ‘‘পিতৃপুরুষের জমি। ফেলে রাখি কী ভাবে?’’

স্থানীয় কৃষক সভার নেতা মহাদেও গোরপাড়ে বলেন, ‘‘এ শুধু কৃষকের আবেগ নয়। আশাও বলতে পারেন। ভাল বৃষ্টি হলে কিছু লাভ হবে এই আশাতেই এরা বুক বেঁধে থাকে।’’

বিদর্ভ এমনিতেই রুক্ষ এলাকা। তার উপরে এ বার এখনও বৃষ্টি হয়নি। জমি ফুটিফাটা। রাস্তার ধারে কলা বাগান, পেঁপে বাগানে গাছের পাতা রোদে পুড়ে হলদে। ছোট ছোট পেঁপে শুকিয়ে যাচ্ছে। জলের অভাবে নেতিয়ে পড়েছে কলাগাছ।

এই এলাকায় সেচের কী হাল, সেটা অবশ্য গ্রামে ঘোরার পথেই বুঝেছিলাম। রাস্তার ধারে কতগুলো ভাঙা বাড়ি দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম গাড়িচালককে। তিনি বললেন, ‘‘এগুলো সেচের অফিস। অফিস হয়েছিল, জলাধার হয়েছিল। ওইটুকুই। চাষির কাছে জল পৌঁছয়নি।’’ করমগাঁওয়ে ঢুকতেই বিরাট এক নিচু জমি। তাতে ঘন ঝোপ। রাস্তা থেকেই দেখা যায়, গ্রামের কয়েক জন মহিলা জলের পাত্র নিয়ে ঝোপের আড়ালে যাচ্ছেন। ওই জমি দেখিয়ে গ্রামের প্রাক্তন সরপঞ্চ দেবানন্দ রাউথ বলেন, ‘‘এটা এক সময় গ্রামের পুকুর ছিল। গত তিন বছর ধরে শুকনো। এখন গ্রামের মানুষের মুক্ত শৌচালয়।’’

এ সবের মধ্যেও যাঁদের সামান্যতম সামর্থ্য আছে, তাঁরা পাম্প বসিয়ে জল তোলেন। কিন্তু টানা খরায় সে জলে টান। আমলাবিষয়ের কৃষক বসন্তরাও দানে বলছিলেন, ‘‘গ্রামের সব কুয়ো শুকিয়ে গেছে। পাম্পেও জল ওঠে না। কবে বৃষ্টি আসবে সেটাই দেখার। বৃষ্টি না হলে পাম্প চালিয়েও কিছু হবে না।’’

খবর, মহারাষ্ট্রে বর্ষা আসতে এখনও দেরি। আর সে বর্ষা কেমন হবে তা নিয়েও দোলাচল রয়েছে।

তবু আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিদর্ভ। আশায় বাঁচে চাষা!

না কি মরে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement