অনিশ্চয়তা একটা ছিলই। তার উপরে জমি বিল-বিরোধী সভায় গজেন্দ্র সিংহের আত্মহত্যার ঘটনায় সংসদের চলতি অধিবেশনে জমি বিল পেশ হওয়ার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রক সূত্রের খবর, জমি বিল নিয়ে আপাতত সরকার কিছুটা সময় হাতে রাখারই পক্ষপাতী। এই মুহূর্তে গজেন্দ্রকে নিয়ে বিরোধী আক্রমণের জবাব দেওয়াটাই বড় কাজ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ মাঠে নেমে গজেন্দ্রর মৃত্যুর দায় খানিকটা পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের দিকেও ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
সংসদের চলতি অধিবেশন শেষ হচ্ছে ৮ মে। জমি বিল পেশ করলে করতে হবে রাজ্যসভাতেই। কারণ, ইউপিএ আমলে আইনটি রাজ্যসভাতেই প্রথম পেশ করা হয়েছিল। ফলে তার সংশোধনী আইনটিও রাজ্যসভাতেই আনতে হবে। রাজ্যসভায় সরকার এমনিতেই সংখ্যালঘু। আর এখন জমি বিল নিয়ে বিরোধীরা সকলেই এককাট্টা। কংগ্রেস তো রয়েছেই। বাম এবং জনতা পরিবার একজোট হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়ে দিয়েছেন, খনি বিলে তাঁরা যে ভূমিকা নিয়েছেন, তা জমি বিলের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে আন্দোলন করে ক্ষমতায় আসা মমতা জমির প্রশ্নে আপস করবেন না। এই অবস্থায় কেন্দ্র চেয়েছিল, জমি বিল যদি রাজ্যসভায় পরাস্ত হয়, তা হলে যৌথ অধিবেশন ডেকে তা পাশ করানো হবে। রাজ্যসভায় পরাস্ত না হলে যৌথ অধিবেশন ডাকা যাবে না। কিন্তু সেই ফর্মুলা মেনে এগোতে গিয়েও কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে সরকারকে।
কী রকম? যৌথ অধিবেশন পরিচালনা করেন লোকসভার স্পিকার। বর্তমান স্পিকার সুমিত্রা মহাজন ইউপিএ আমলে ছিলেন গ্রামোন্নয়ন সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রধান। সে সময় জমি বিল নিয়ে আলোচনায় সুমিত্রা সঙ্ঘ পরিবারের ছ’দফা প্রস্তাব নিয়ে সওয়াল করেন। জমি বিল সংশোধনী আইনে কিন্তু সেই ছ’দফা প্রস্তাব ঠাঁই পায়নি। ফলে সুমিত্রার পক্ষে বিষয়টি কিছুটা অস্বস্তিকর। তিনি সে কথা বিজেপি নেতৃত্বকে জানিয়েছেন। অন্য দিকে রাজ্যসভায় বিলটি পেশ করার দিনক্ষণ স্থির করার জন্য বেঙ্কাইয়া নায়ডু অনুরোধ করেছিলেন রাজ্যসভার স্পিকার হামিদ আনসারিকে। আনসারি জানিয়েছেন, বিলটি পেশ করার সময় যে বিরোধীরা গোলমাল করবেন না, সেটা আগে সরকার নিশ্চিত করুক। আর ঠিক এইখানেই ঠোক্কর খাচ্ছে সরকার। বিরোধীরাও কোমর বেঁধে রয়েছেন। তাঁরাও ঠিক করে রেখেছেন, বিলটি টেবিলে আনতেই দেবেন না তাঁরা।
এই আবহেই গলায় ফাঁস দিয়েছেন গজেন্দ্র। জমি বিলও তাই আপাতত ঝুলে গিয়েছে। আপাতত সরকারের পয়লা নম্বর কাজ হল, নিজের গা থেকে কৃষক-বিরোধী তকমা দূর করা।
এক দিকে কংগ্রেস, অন্য দিকে আপ— জমি বিল নিয়ে লাগাতার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে। দেশে ফিরে রাহুল গাঁধীও নতুন উৎসাহে তোপ দাগতে শুরু করেছেন। গরিব আর কৃষকের স্বার্থের প্রশ্নটিই এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে। বিজেপি নেতৃত্ব ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করছেন, জমি বিল সংশোধনী আনতে চেয়ে তাঁরা কোনও অন্যায় করেননি ঠিকই। কিন্তু এই কথাটা মানুষকে বোঝানোর ক্ষেত্রে খামতি থেকে গিয়েছে। বিরোধীরা বরং তাঁদের কাজটা অনেক ভাল ভাবে করেছেন। ফলে জমি বিলটি কৃষকের স্বার্থের বিরোধী, এমন একটা ধারণা জনমানসে চারিয়ে গিয়েছে। সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে গজেন্দ্রর আত্মহত্যা। রাজনীতির উত্তাপও বহ গুণে বেড়ে গিয়েছে।
পরিস্থি্তি আঁচ করে গত কালই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তড়িঘড়ি টুইট করে শোক জানিয়ে রেখেছিলেন। তার পরেও আজ প্রধানমন্ত্রীকেই সরাসরি আক্রমণ করে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় সংসদে বলেছেন, ‘‘শুধু টুইট করলেই হবে না। আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রীকে লোকসভায় থাকা উচিত ছিল।’’ এনসিপির সাংসদ তারিক আনোয়ার বলেন, ‘‘সরকার জমি বিল আনছে বলেই গজেন্দ্র আত্মহত্যা করেছেন।’’এই রকম একটা সময় জমি বিল নিয়ে তাড়াহুড়ো করলে তার ফল যে খারাপ বই ভাল হবে না, বিলক্ষণ বুঝছেন বিজেপি নেতৃত্ব। তার চেয়ে, বিজেপি মনে করছে, হাতে সময় নিয়ে একটু ধীরে চলা ভাল। তা হলে গজেন্দ্রকে নিয়ে এই চাঞ্চল্যও থিতিয়ে যাবে। আর সেই সঙ্গে মানুষকে জমি বিলের স্বরূপ বোঝানোর কাজটাও খানিকটা এগিয়ে নেওয়া যাবে। দিল্লি বিধানসভায় পরাজয়ের পিছনেও জমি নীতি নিয়ে বিরোধী-প্রচার একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করে দল। ফলে তারা বিষয়টি নিয়ে বুঝেসুঝেই পা ফেলতে চাইছে।
এমনিতে জমি বিলের বিরোধিতা আর দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ— গজেন্দ্রর মৃত্যুকে ঘিরে এই দু’টি প্রশ্নে বিজেপির নাম জড়িয়েই গিয়েছে। এখন জমি বিল নিয়ে এগোনোর চেয়ে বিরোধীদের আক্রমণের জবাব দেওয়া এবং পাল্টা আক্রমণে যাওয়াটাই বিজেপির কাছে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। গজেন্দ্রর মৃত্যুর এফআইআর-এ আজ দিল্লি পুলিশ আপ-এর নাম রেখেছে। পুলিশ সূত্রে দাবি, গত কাল গজেন্দ্রকে ওই কাণ্ড ঘটাতে উস্কানি দিয়েছিলেন এক দল আপ সমর্থক। এ ছাড়া মৃতের পরিবারের অভিযোগ, গত কাল ওই সমাবেশে আসার জন্য গজেন্দ্রকে ডেকেছিলেন আপ নেতা মণীশ সিসৌদিয়া। পুলিশ তাই মণীশের ভূমিকাও খতিয়ে দেখছে। পাশাপাশি বিজেপি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, ওই কৃষক যথেষ্ট সম্পন্ন পরিবারের। চলতি অকাল বর্ষণে তাঁর কেবল ২০-২৫ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়েছিল। সুতরাং ফসল নষ্ট হওয়া তাঁর আত্মহত্যার কারণ হতে পারে না। বিজেপি শিবিরের দাবি, গজেন্দ্র চক্রান্তের শিকার। কারা এর পিছনে রয়েছে তা সামনে আনার দাবি জানিয়েছে দল।
তা ছাড়া ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে আজ বিজেপির তরফে কংগ্রেসকেও নিশানা করার চেষ্টা শুরু হয়েছে। এমনিতেই জমি বিলকে কেন্দ্র করে বিজেপিকে কৃষক-বিরোধী বলে আক্রমণ শানাচ্ছিল কংগ্রেস। গজেন্দ্রর ঘটনা তাদের আরও সুর চড়ানোর সুযোগ এনে দিয়েছে। বিজেপি শিবির বুঝতে পারছে, শুধু আপ-কে কাঠগড়ায় তুললে কংগ্রেসের সুবিধা হবে। তাই শেষ বেলায় মাঠে নেমে এ দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, কৃষকদের এই দুরবস্থার জন্য অতীত সরকারের ভুল নীতি দায়ী কিনা তা-ও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘এটি একটি পুরনো সমস্যা। আমাদের দেখতে হবে এর আগে কোন ভুল পথে চলার জন্য এই সমস্যা এত গভীর আকার ধারণ করেছে।’’