প্রিন্সিপাল আর্থিক উপদেষ্টা সঞ্জীব সান্যাল। ছবি পিটিআই।
প্রশ্ন: কোভিড অতিমারি, লকডাউনের ধাক্কায় রাজ্যের রাজকোষের হালও খুব খারাপ। পরিকাঠামোয় খরচ করার মতো অর্থ নেই। বাজেটে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, পরিকাঠামোয় খরচের জন্য ৫০ বছরের জন্য বিনা সুদে রাজ্যগুলিকে ১ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে। তা কি যথেষ্ট?
সঞ্জীব: রাজ্য সরকারের রাজস্ব আয়ও এখন বাড়ছে। কোভিডের প্রথম বছর, ২০২০-২১-এ কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজকোষে একই রকম সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। কারণও ছিল এক। অতিমারি, লকডাউন, তার ফলাফল। ২০২১-২২-এ দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। অর্থনীতিতে প্রভাব খুবই সামান্য। সরকারের রাজস্ব আয়ে প্রভাব আরও কম। বরং রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়েছে। জিএসটি থেকে আয় বেশি হওয়ায় রাজ্যও তার ভাগ বেশি পাচ্ছে। রাজ্যগুলিকে বেশি মাত্রায়, রাজ্যের জিডিপি-র ৪% পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এ বার সরাসরি বিনা সুদে, খুবই উদার শর্তে ১ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হচ্ছে। ফলে রাজ্যের হাতে পরিকাঠামোয় খরচের অর্থ থাকবে।
প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান মুখ্য উপদেষ্টা অমিত মিত্রের অভিযোগ, বাড়তি ঋণের অনুমতির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সংস্কারের শর্ত জোড়া হচ্ছে। এক লক্ষ কোটি টাকা ঋণের সঙ্গেও কেন্দ্র প্রচুর শর্ত চাপাচ্ছে। রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা বলছেন, কেন্দ্র সেস বসানোয় কেন্দ্রীয় কর থেকে রাজ্যের ভাগ কমছে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের প্রাপ্য কমানো হচ্ছে। তার বদলে না কি ঋণ দেওয়া হচ্ছে!
সঞ্জীব: অভিযোগ ঠিক নয়। অর্থ কমিশনের সূত্র মেনেই কেন্দ্রীয় করের ভাগ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় প্রকল্পেও রাজ্য সাহায্য পাচ্ছে। অতিরিক্ত ঋণে শর্ত অবশ্যই রয়েছে। তবে তা যুক্তিসঙ্গত বলেই অর্থনীতির ম্যানেজাররা মনে করবেন। যে সব সংস্কারের কথা বলা হয়েছে, তার সবই অর্থনীতির জন্য ভাল।
প্রশ্ন: কেন্দ্রের আয়ের ৩৫% ঋণ থেকে আসছে। খরচের ২০% সুদ মেটাতে চলে যাচ্ছে। জিডিপি-র অনুপাতে ঋণের বোঝা বাড়ছে। অর্থনীতিতে চাঙ্গা করতে খরচের ক্ষেত্রে সরকারের হাতে কি যথেষ্ট অর্থ থাকছে?
সঞ্জীব: নতুন কোনও সমস্যা নয়। ঐতিহাসিক ভাবেই পুরনো ঋণের বোঝা থাকে। কোভিডের সময় মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে ঋণ বেড়েছে। সুদও মেটাতে হবে। রাজকোষ ঘাটতি এবার ০.৫ শতাংশ অঙ্ক কমানো হয়েছে। তবে অর্থনীতিতে চাঙ্গা করতে খরচ করা দরকার। তাই খুব তাড়াতাড়ি ঘাটতি কমানো যাবে না। তবে খরচ করার অর্থ যথেষ্ট রয়েছে।
প্রশ্ন: ঋণের বোঝা কমাতে ভবিষ্যতের রূপরেখা কী?
সঞ্জীব: এটা বেশি দিন চলতে পারে না। ভবিষ্যতে ঋণের বোঝা কমাতেই হবে। প্রশ্ন হল, কত তাড়াতাড়ি। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ২০২৫-২৬-এ রাজকোষ ঘাটতিকে ৪.৫ শতাংশে নামিয়ে আনবেন। যুক্তিসঙ্গত রূপরেখা। হঠাৎ করে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দিয়ে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দাওয়াই তুলে নেওয়া যাবে না।
প্রশ্ন: দেশে দারিদ্র বাড়ছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। অক্সফ্যামের রিপোর্ট, কোভিড কালে ধনী-দরিদ্র অসাম্য বেড়েছে। সরকার দারিদ্র- সমস্যাকে কী ভাবে দেখছে?
সঞ্জীব: এই সব এনজিও-র রিপোর্টের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নই। এর মধ্যে অনেক স্বার্থ জড়িত। বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দারিদ্র কমেছে বলে কখনও রিপোর্ট দেখিনি। সরকারের মনোভাব হল, আমরা দরিদ্রদের জন্য দু’ভাবে কাজ করছি। লকডাউনের সময় জরুরি ভিত্তিতে বিনা মূল্যে রেশন, নগদ অর্থ সাহায্য করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বাড়ি, শৌচালয়, নলবাহিত জলের কাজ চলছে। আসল পদক্ষেপ হল, প্রাথমিক এই সাহায্য পেয়ে গরিবরা যখন মাথা তুলবেন, তখন তাঁদের কাছে বিশ্ব মানের পরিকাঠামোর সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। ধনীরা কেন ধনী? বেশি বুদ্ধিমান বা উন্নত প্রাণী বলে? তা নয়। বিশ্ব মানের পরিকাঠামোর সুবিধা নিতে পারেন বলে। দরিদ্ররা সেই সুবিধা পেলে তাঁদেরও উন্নয়ন হবে।
প্রশ্ন: মূল্যবৃদ্ধি চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। আপনি নিজেও অশোধিত তেলের দাম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সমাধান কী?
সঞ্জীব: চলতি বছরে পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। সেই তুলনায় আগামী বছর কমবে। দেশের বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অনেকটাই লাগামে। প্রয়োজনে আরও পদক্ষেপ করা হবে। চিন্তা হল, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, যা এ দেশেও ধাক্কা দেবে। অশোধিত তেলের দাম, ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সঙ্কট, জোগানের ক্ষেত্রে কন্টেনারের অভাব, চিপের অভাব—এ সব দিকে সরকারের নজর রাখতে হবে। এই সব পরিস্থিতির দ্রুত বদল হচ্ছে। ইউক্রেনে কী হবে, তা এখনই ভবিষ্যৎবাণী করতে পারি না।
প্রশ্ন: বেকারত্বের সমস্যা, কর্মসংস্থান তৈরি নিয়ে কি সরকারের নতুন করে ভাবা দরকার?
সঞ্জীব: এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই যে চাকরি তৈরি করতে হবে। বিরাট ভাবে পরিকাঠামোয় খরচ করে অর্থকরী সম্পদ তৈরি হচ্ছে। প্রচুর কাজ তৈরি হবে। প্রথমেই নির্মাণ ক্ষেত্রে, মাঝারি মাপের প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের জন্য। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে। লক্ষ্য, বেসরকারি লগ্নি টেনে আনা। শিল্পমহল লগ্নি শুরু করলে ব্যাঙ্কে ঋণের অভাব হবে না। শেয়ার বাজার থেকেও বহু সংস্থা পুঁজি তুলছে। ইতিমধ্যে লাল ফিতের ফাঁস কাটানো, ব্যবসার প্রক্রিয়া সহজ করার কাজ চলছে। স্টার্ট-আপে সাহায্য করা হচ্ছে।
প্রশ্ন: আগামী বছরে বিলগ্নিকরণ থেকে সরকারের আয়ের লক্ষ্য খুবই কম। প্রতিবাদের মুখে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থার বেসরকারিকরণ কি থমকে গেল?
সঞ্জীব: বেসরকারিকরণের জন্য সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সবটাই বাজারের পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো কোনও পাঁচ বছরের পরিকল্পনা নেই যে তার মধ্যে সব বেসরকারিকরণ করে ফেলতে হবে। প্রক্রিয়া মেনে, পরিস্থিতি অনুযায়ী ঘোষিত নীতি মেনেই বেসরকারিকরণ হবে।