Education

‘কর্পোরেট হল শিক্ষা, মুছে গেল গণতন্ত্রও’

রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এই নীতি পাশ করিয়ে অগ্রাহ্য করা হল ভারতীয় গণতন্ত্রকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২০ ০৪:৪৫
Share:

শিক্ষা শিবিরের একাংশের মতে, এই শিক্ষানীতি শিক্ষার বাণিজ্যকরণ ও কেন্দ্রীকরণ ঘটাল। শিক্ষাকে নিয়ে গেল ‘কর্পোরেটাইজেশনের’ দিকে। ছবি: সংগৃহীত।

খসড়া অবস্থাতেই দেশ জুড়ে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিল জাতীয় শিক্ষানীতি। এ বার মন্ত্রিসভায় পাশের পরে তা নিয়ে বিতর্ক আরও বাড়ল। শিক্ষা শিবিরের একাংশের মতে, এই শিক্ষানীতি শিক্ষার বাণিজ্যকরণ ও কেন্দ্রীকরণ ঘটাল। শিক্ষাকে নিয়ে গেল ‘কর্পোরেটাইজেশনের’ দিকে। সর্বোপরি রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এই নীতি পাশ করিয়ে অগ্রাহ্য করা হল ভারতীয় গণতন্ত্রকে।

Advertisement

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় শিক্ষক সংগঠন আইফুকটো-র সভাপতি এবং রাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির (ওয়েবকুটা) সাধারণ সম্পাদক কেশব ভট্টাচার্য বুধবার বলেন, ‘‘খসড়া অবস্থা থেকেই এই শিক্ষানীতির প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছি। যে-সব বিষয় এই নীতির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাতে শিক্ষার পূর্ণ কেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে তাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বাণিজ্যকরণের দিকে। শিক্ষা এখন কর্পোরেটের পণ্য।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক কেশববাবুর মতে, এর ফলে উচ্চশিক্ষায় দরিদ্র ও মেধাবী পড়ুয়াদের ঢোকার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।

সব রাজ্য ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা না-করেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় জাতীয় শিক্ষানীতি পাশ করিয়ে নেওয়াটাকে তুঘলকি সিদ্ধান্ত আখ্যা দিলেন রাজ্যের পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার। তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত। আলোচনা ছাড়া এ ভাবে শিক্ষানীতি পাশ করানোটা গণতন্ত্র মুছে দেওয়ার শামিল।’’ এই নীতিতে স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষাকে গুরুত্বহীন করে দেওয়ারও বিরোধিতা করেছেন তিনি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং তার আগের তিন বছর মিলিয়ে পাঁচ বছরের ভিত তৈরি, তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি প্রস্তুতি পর্ব, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির মধ্য পর্ব, নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি মাধ্যমিক শিক্ষা— এ ভাবে ভাগেরও বিরোধিতা করেছেন অভীকবাবু। তিনি বলেন, ‘‘তা হলে তো নবম শ্রেণিতেই পড়ুয়াকে ঠিক করতে হবে, সে ভবিষ্যতে কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবে। নবম শ্রেণির পড়ুয়ার পক্ষে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া কি সম্ভব! নবম থেকে দ্বাদশকে একটি ইউনিট ধরা সম্পূর্ণ পরিকল্পনাহীন সিদ্ধান্ত।’’ তিন বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি আবশ্যিক হওয়ায় আরও ক্লাসঘর, আরও শিক্ষক লাগবে। স্কুলের পরিকাঠামো পাল্টাতে হবে। এত দ্রুত কি সব সম্ভব— প্রশ্ন তুলেছেন অভীকবাবু। তিনি বলেন, ‘‘এই শিক্ষানীতিতে আঞ্চলিক ভাষার বদলে হিন্দিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থানকে’ প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।’’ অভীকবাবুর প্রশ্ন, সংসদের দুই কক্ষে আলোচনাই তো হল না। তা হলে এটাকে জাতীয় শিক্ষানীতি বলা যাবে, নাকি দলীয় শিক্ষানীতি?

Advertisement

স্কুলের জন্য

• সাক্ষরতা, সংখ্যা পরিচয়ে জোর। খেলার ছলে পড়া ভাল লাগানোর চেষ্টা।
• সামগ্রিক (বিশেষত হাতে-কলমে প্রয়োগের) শিক্ষা, সৃজনশীলতা, দলগত ভাবে কাজ করার ক্ষমতা তৈরিতে গুরুত্ব।
• বিশেষ নজর অঙ্ক-নির্ভর, বৈজ্ঞানিক মননে। আলাদা যত্ন বিশেষ ভাবে সক্ষম ও বাড়তি মেধাবীদের প্রতি।
• একাধিক ভাষা শিক্ষা ও ডিজিটাল দক্ষতায় জোর। কম্পিউটার কোডিংয়ের প্রথম পাঠ ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে।

সামনে লক্ষ্য

• ২০৩০-র মধ্যে সকলকে স্কুলে টেনে আনা।
• ফিরিয়ে আনা ২ কোটি স্কুল-ছুটকেও।
• সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে শিক্ষার একই মান।
• অন্তত একটি দক্ষতা নিয়ে স্কুলের ছাড়বে পড়ুয়া।

উচ্চশিক্ষার জন্য

• বিভিন্ন বিষয় মিলিয়ে-মিশিয়ে পড়ার সুযোগ। পদার্থবিদ্যার পড়ুয়া পাশাপাশি করতে পারবেন সাহিত্যের ক্লাসও।
• পড়াশোনা থেকে পরীক্ষা-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ। তৈরি হবে জাতীয় শিক্ষা প্রযুক্তি ফোরাম।
• জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি। পালি, ফার্সি, প্রাকৃত ভাষার জাতীয় প্রতিষ্ঠান।
• সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য (ডিমড্, কেন্দ্রীয়, সরকারি, বেসরকারি) একই রকম নিয়ম। ফি নির্ধারণ শিক্ষা বোর্ডের নিয়ম মেনে।
• লক্ষ্য, শিক্ষায় কেন্দ্র ও রাজ্যের মিলিত বরাদ্দ জিডিপির ৬%-এ নিয়ে যাওয়া। এখন যা ৪.৪৩%। উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হার ২০৩৫-এর মধ্যে ৫০ করা।
• ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, স্থানীয় শিল্পকলা চেনায় জোর।

রাজ্যের সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও চন্দননগর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ দেবাশিস সরকার মনে করেন, এই শিক্ষানীতি গরিব-বড়লোক ভেদাভেদ আরও স্পষ্ট করে দেবে। এই নীতি অনলাইন শিক্ষায় জোর দিয়েছে। ফলে যাদের কাছে ইন্টারনেট আজও লভ্য নয়, তারা বঞ্চিত হবে। ‘‘দেশের অধিকাংশ মানুষ নেট পরিষেবা পায় না। ফলে এই নীতি ‘ডিজিটাল ডিভাইডের’ সৃষ্টি করবে।’’ সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক তরুণ নস্করের মতে, বিদ্যাসাগরের ১৩০তম প্রয়াণ দিবসে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি পাশ করিয়ে নেওয়ায় এটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রইল। তিনি বলেন, ‘‘এই নীতি শিক্ষার কর্পোরেটকরণের রাস্তা খুলে দেবে, মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার জন্ম দিতে সাহায্য করবে, গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার মূলে কুঠারাঘাত করবে। শিক্ষার একটিই নিয়ন্ত্রক সংস্থা গড়ে কেন্দ্রীকরণ চালানো হবে।’’

আরও পড়ুন: শিক্ষামন্ত্রীর প্রত্যাবর্তন, নয়া নীতিতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি জুটা-র সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার সম্পর্কে আগের দু’টি শিক্ষা কমিশনের ধারণাকে নস্যাৎ করে উচ্চশিক্ষার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদলে স্বৈরতান্ত্রিক এবং একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করল এই শিক্ষানীতি। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ১০০ বছর পিছিয়ে দেবে এই নীতি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কুটা-র সাধারণ সম্পাদক সাংখ্যায়ন চৌধুরী বলেন, ‘‘এই শিক্ষানীতি রাজ্যের ভূমিকাকে সঙ্কুচিত করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে পৃথক করায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে আর পঠনপাঠন ও গবেষণার জায়গা বলে ধরা হবে না।’’ শিক্ষক সংগঠন আবুটা-র সাধারণ সম্পাদক গৌতম মাইতির মতে, এই শিক্ষানীতির নামে একটি নিখুঁত মার্কেট মডেল চালু হতে চলেছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যকরণ সেরে ফেলল সরকার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement