বিদেশি মুদ্রায় ঋণ কেন? মোদী সরকারকে সতর্ক করছেন অর্থনীতিবিদেরা

২০১৩-তেও মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের নীতির ফলে দেশের বাজারে ডলারের টানাটানি। ফলে ডলারের দাম ৭০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৯ ০২:৫৫
Share:

—ফাইল চিত্র।

সাল ১৯৯১। বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। এ দিকে জ্বালানি আমদানি করার ডলার চাই। না-হলে দেশ চলবে না। সেই কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের কাছে সোনা বন্ধক রেখে কেন্দ্রকে ঋণ নিতে হয়েছিল। কিন্তু তখনও আন্তর্জাতিক বাজারে বন্ড বা ঋণপত্র ছেড়ে বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার পথে হাঁটেননি নরসিংহ রাও-মনমোহন সিংহ।

Advertisement

২০১৩-তেও মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের নীতির ফলে দেশের বাজারে ডলারের টানাটানি। ফলে ডলারের দাম ৭০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই সময়েও মনমোহন সরকার বিদেশি মুদ্রায় বা ডলারে ঋণ নেওয়ার ঝুঁকি নেয়নি। কারণ ছিল একটাই। আন্তর্জাতিক বাজারে অনিশ্চয়তার ধাক্কায় যদি ডলারের দাম আচমকা তুঙ্গে ওঠে, তা হলে সেই অনুযায়ীই টাকা শোধ করতে হবে।

এ বার নরেন্দ্র মোদী সরকার বিদেশি লগ্নিকারীদের থেকে বিদেশি মুদ্রাতেই ঋণ নেওয়ার পথে হাঁটতে চাইছে। শুক্রবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বাজেটে এই ঘোষণা করেছেন। লক্ষ্য হল, কম সুদে ঋণ নেওয়া। কারণ, মোদী জমানায় কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণের বহর ৫০ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের বাজেট বরাদ্দের ২৩.৭ শতাংশই চলে যাচ্ছে সুদ মেটাতে।

Advertisement

কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশি মুদ্রায় ঋণ নেওয়ার ভাল দিক যেমন রয়েছে, তেমনই প্রবল ঝুঁকিও রয়েছে। ঝুঁকি কোথায়? ধরা যাক, ধার নেওয়ার সময় ডলারের দাম ছিল ৫০ টাকা। সেই হিসেবে এক ডলার ধার করলে ৫০ টাকা শোধ করার দায়। কিন্তু ডলারের দাম যদি কোনও কারণে ৭০ টাকায় পৌঁছে যায়, তা হলে ৭০ টাকাই শোধ করার দায় এসে পড়বে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এই পথে হেঁটেই আশি ও নব্বইয়ের দশকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলি ঋণের ফাঁদে পড়েছিল। ১৯৯৭-তে তাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো অর্থনীতিতে ‘এশিয়ার বাঘ’ বলে পরিচিত দেশগুলিও একই কারণে সঙ্কটে পড়ে। এ দেশের অনেক শিল্প সংস্থাও একই বিপদে পড়েছে। সরকারি সূত্রের দাবি, মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা কৃষ্ণমূর্তি সুব্রহ্মণ্যন কম সুদে বিদেশ থেকে ধার নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত বন্ডের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ঋণ নিলে সরকারকে অনেক কম সুদ গুনতে হবে। ফলে সরকারের সুদের বোঝা কমবে। সরকারি ঋণের বেশ কিছুটা বিদেশ থেকে এলে,

দেশের বাজারে বেসরকারি লগ্নিকারীদের ঋণ দেওয়ার জন্য আরও বেশি টাকা থাকবে। ফলে দেশেও সুদের হার কমবে।

অর্থনীতিবিদ অজিত রাণাডের মতে, ভাল দিক থাকলেও এই ভাবনা নানা দিক থেকে বিপজ্জনক। এক তো আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের ওঠানামার সঙ্গে দেশের ঋণ শোধ করার দায়ও ওঠানামা করবে। দুই, এর ফলে দেশের বাজারেও সুদ ওঠানামা করতে পারে। তিন, শুধু দেশের বাজার থেকে ধার নেওয়ার সীমাবদ্ধতা থাকলে, সরকারের ঘাটতি বাড়ানো বা ঋণ নেওয়ার উপরেও অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ থাকে। কারণ দেশের বাজার থেকে সরকার যথেচ্ছ ঋণ নিতে পারে না। বেসরকারি শিল্পের ঋণের জন্যও জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু বিদেশের বাজারে চাইলে সরকার অনেক বেশি সুদ গুনেও ধার করে ফেলতে পারে।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর সি রঙ্গরাজনের বক্তব্য, ‘‘আমরা নব্বইয়ের দশকে শুরুতে এ নিয়ে আলোচনা করে ঠিক করেছিলাম, ও পথে না-হাঁটাই ভাল। তা ছাড়া, দেশে বিদেশি মুদ্রার যদি টানাটানি না-থাকে, তা হলে ও পথে হাঁটার কারণ নেই।’’ ২০১৮-১৯ সালে দেশে আসা বিদেশি মুদ্রার পরিমাণ ৬ শতাংশ বেড়েছে। বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি দেশের বন্ডে লগ্নি করছেই। কিন্তু সেই বন্ডের মূল্য টাকাতেই ঠিক হয়। সরকার নিজেই বলছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর রাকেশ মোহনের যুক্তি, ‘‘খাতায়-কলমে যা-ই হোক, বাজেটের বাইরের খরচ, রাজ্যের ঘাটতি ধরলে দেশের রাজকোষ ঘাটতি জিডিপির ৮ থেকে ৯ শতাংশ। তা পূরণ করতে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া হয় না বলেই আর্থিক স্থিতিশীলতা রয়েছে।’’

অর্থসচিব সুভাষচন্দ্র গর্গের হিসেবে, চলতি অর্থ বছরে মোট সরকারি ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ, অর্থাৎ ৭০ হাজার কোটি টাকা বিদেশ থেকে ধার করা হবে। ধারের টাকা মূলত পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ হবে। অর্থ মন্ত্রকের দাবি, দেশের অর্থনীতির ভিত যথেষ্ট মজবুত। তা দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও যথেষ্ট কম। ফলে বিপদের আশঙ্কাও প্রায় নেই।

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement