দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে পলবা সিটিতে ‘প্রবাসী বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশন’-এর পুজোয়। নিজস্ব চিত্র
আলোর রোশনাইয়ে যখন উজ্জ্বল গোটা তিলোত্তমা, সেই সময়ে আরব সাগরের পাড়ে বলিউডের শহরে কিন্তু শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি তুঙ্গে। মুম্বইয়ে পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে মূলত পঞ্চমী থেকে। ষষ্ঠী থেকে বিভিন্ন মণ্ডপে উপচে পড়ে ভিড়। এ শহরের দুর্গাপুজোর সংস্কৃতি খানিক স্বতন্ত্র। আবেগ-আন্তরিকতা-পারস্পরিক বন্ধনের মেলবন্ধনে বাণিজ্যনগরীর এক-একটা মণ্ডপ যেন এক-একটা ছোট্ট কলকাতা। পুজোর ভোগ-মিউজ়িক কনসার্টের জৌলুসে অন্য মাত্রা নেয় সেই উদ্যাপন। পুজোর বিপুল কর্মযজ্ঞের শুরুটা হয় মাস ছয়েক আগে থেকেই। পার্ক, হল কিংবা অডিটোরিয়াম আগাম ভাড়া নিতে হয়। সঙ্গে প্রশাসনিক অনুমতি। এ ব্যাপারে নিয়ম খুব কড়া।
মায়ের পুজোয় কোনও রকমে আপস করতে নারাজ উদ্যোক্তারা। এমনই এক জন ‘প্রবাসী বেঙ্গলী অ্যাসোসিয়েশন’-এর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য অপরাজিতা রায় থিমপুজোর পক্ষে। এ বারে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে মণ্ডপ তৈরি করছেন তাঁরা। পুজোর বয়স মাত্র আট বছর। কিন্তু অল্প সময়েই নজর কেড়েছে ডোম্বীবলীর পলবা সিটিতে আয়োজিত এই পুজো। অপরাজিতা বলেন, ‘‘আগে পুজো দেখতে মুম্বই যেতে হত। আমি ও আমার স্বামী ঠিক করেছিলাম এখানেই পুজো করব। আট বছর আগে সাতটি পরিবার মিলে পুজো শুরু করি। আজ হাজারেরও বেশি সদস্য।’’
এই পুজোয় অবাঙালিদের উৎসাহও চোখে পড়ার মতো, দাবি অপরাজিতার। তিনি বলেন, ‘‘মরাঠিদের অনেকে তো দুর্গাপুজো সম্বন্ধে জানতেন না। এখন আমাদের সঙ্গে আরতি-অঞ্জলিতেও যোগ দেন। ডোম্বীবলী, কল্যাণে এটা সবচেয়ে বড় পুজো। এ বারে আমাদের ঠাকুরের উচ্চতা ১১ ফুট।’’
অপরাজিতাদের মতোই মণ্ডপসজ্জায় অভিনবত্ব দেখা যায় স্পন্দন পওয়াই দুর্গোৎসবেও। এর আগে মহিলাদের ক্ষমতায়ন, পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় উঠে এসেছে মণ্ডপসজ্জায়। এ বারের থিম ‘বৈচিত্র, সমন্বয়করণ এবং সমতা’। পুজোর বাজেট ৬০ লক্ষ টাকা। কোষাধ্যক্ষ শুভজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘এ বারে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মণ্ডপ তৈরির দায়িত্বে রয়েছেন মহিলা। মহিলা ঢাকিও আনা হয়েছে।’’
মণ্ডপসজ্জার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। শুভজিৎ বলেন, ‘‘এ বার কলকাতার একটি ব্যান্ড আসছে। অষ্টমীতে থাকছেন জলি মুখোপাধ্যায়। নবমীতে নীলাঞ্জনা রায়। এর পাশাপাশি সদস্যরাও অনুষ্ঠান করেন। গত কয়েক মাস তার প্রস্তুতিও চলছে। এর পাশাপাশি কুইজ, ধুনুচি নাচও এই পুজোর আকর্ষণ।’’ সদস্যেরা মুখিয়ে থাকেন পঞ্চমীতে আনন্দমেলার জন্যও। ওই দিনটায় সদস্যদের পরিজন খাবারের স্টল দেন। বিকিকিনিতে অংশ নেয় খুদেরাও।
আনন্দমেলায় হইচই হয় জুহু কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের পুজোতেও। সভাপতি বিশ্ববরণ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সদস্য ও পরিচিতেরা বাড়ি থেকে খাবার তৈরি করে আনেন। তা বিক্রি হয়। আমরা সকলে খুব আনন্দ করি। আর বিক্রি থেকে যা লাভ হয়, খরচ করা হয় সামাজিক কাজে।’’ এই পুজোর বয়স ২৩ বছর। বিশ্ব মুম্বইয়ে রয়েছেন তারও আগে থেকে। কলকাতা ও মুম্বইয়ের মধ্যে পুজোয় কী তফাৎ? বিশ্ব বলেন, ‘‘কলকাতায় মণ্ডপসজ্জা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিন্তু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ভোগের আয়োজনের উপরেই সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর একটা বিষয় হল, কলকাতার পুজোয় দর্শনার্থীদের বেশিক্ষণ মণ্ডপে থাকার উপায় থাকে না। আমরা আশা করি, যাঁরা আসবেন তাঁরা যেন চলে না যান।’’
পুজোর আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাঝেও পাখির চোখ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। বিশ্বের কথায়, ‘‘কোন পুজোয় অনুষ্ঠান কেমন হচ্ছে এবং ভোগ খাওয়ানো নিয়ে সম্মানের লড়াই চলে।’’ পুজোয় প্রতিদিন হাজারখানেক দর্শনার্থীর ভোগের বন্দোবস্ত থাকে। আর একটা বিষয় হল প্রবীণ নাগরিকদের আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের পরিবেশন করেন আমাদের প্রবীণ সদস্যেরা। ভোগে খিচুড়ি আবশ্যিক। সঙ্গে রকমারি পদ। শেষ পাতে চাটনি, পায়েস, মিষ্টি।
ভোগ খাওয়ানোর উপরে জোর দেয় বম্বে দুর্গাবাড়ি সমিতিও। ৯৩ বছরের এই পুজোর চেয়ারপার্সন মিতালি পোদ্দার বলেন, ‘‘প্রতিদিন পাঁচ হাজার মানুষের ভোগের ব্যবস্থা থাকে। আমরা মহিলারাই পরিবেশন করি।’’ ছ’মাস আগে থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। শুধু পুজোর আয়োজন নয়, পুজোর দিনগুলোয় অনুষ্ঠানের জন্যও রিহার্সাল শুরু করে দেন সদস্যেরা। এ ছাড়া বিখ্যাত শিল্পীদেরও নিয়ে আসা হয়। এ বারে অমিত কুমারের পাশাপাশি শোনা যাবে ‘ভূমি’র গানও। পুজোর পুরোহিত এবং ঢাকি আসেন কলকাতা থেকে। নবমীর অনুষ্ঠানেও অংশ নেন ঢাকিরা। করোনায় আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকিদের পাশে থাকার বার্তাও দিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
আমবাঙালি সারা বছর পুজোর জন্য মুখিয়ে থাকলেও এই সময়ে নিজের গানের দল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন পিলু বিদ্যার্থী। বিবাহসূত্রে বহু বছর আগে কলকাতা থেকে মুম্বইয়ে এসেছেন। অনুষ্ঠানের ফাঁকেই বিভিন্ন পুজোমণ্ডপে ঘুরে নেন। দেখা হয়ে যায় পরিচিতদের সঙ্গে। পুজোয় দু’শহরের আবহাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘মুম্বইয়ে যেখানে পুজো হয় সেই চত্বরে পা না-রাখলে মনে হয় না পুজো হচ্ছে। আর এই সময়ে কলকাতার সর্বত্রই পুজো-পুজো গন্ধ।’’