যে-নদী মরুপথে ধারা হারিয়েছে, কবি জানতেন, সে হারায়নি। জানতেন, ভাষাও নদীর মতন। সেই ভাষা-নদী ধারা হারালে কী ভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে? তাকে কি আদৌ টিকিয়ে রাখা যায়? নাকি চিরবিলুপ্তির গহ্বরে হারিয়ে যাওয়াটাই ওই সব ভাষার নিয়তি?
সেই নিয়তির সঙ্গে একটা লড়াই লড়তে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রেজিস্ট্রার জেনারেল এবং সেন্সাস কমিশনারের দফতরের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে,
শুধু ভারতেই এমন অবলুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় ভাষার সংখ্যা প্রায় ৫৮৫। বিলুপ্তির কবল থেকে ভাষাগুলির অস্তিত্ব রক্ষায় একটি অভিনব পরিকল্পনা করছে কেন্দ্র।
ছবি তুলে প্রিয়জনের স্মৃতি টিকিয়ে রাখতে চায় মানুষ। একই ভাবে শ্রুতি-স্মৃতি ধরে রেখে বিভিন্ন বিপন্ন ভাষাকে আরও কিছুটা আয়ু দেওয়ার উদ্যোগ চলছে। প্রায়-লুপ্ত ভাষাগুলি যে-সামান্য সংখ্যক মানুষের মুখে কায়ক্লেশে টিকে আছে, তথ্যচিত্রে তাঁদের ঠাঁই দিয়ে সেই সব ভাষা সংরক্ষণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তথ্যচিত্র নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বা এনএফডিসি। খরচ ধরা হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা।
এনএফডিসি-র প্রকল্প আধিকারিক অর্ণব মিদ্যা জানান, ওই ৫৮৫টি ভাষার ডকুমেন্টেশনের কাজটিকে তিন পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে ১৮৫টি ভাষা। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে থাকছে ২০০টি করে ভাষা।
‘ডকুমেন্টেশন’-এর এই কাজ চলছে ঠিক কী ভাবে?
কলকাতায় এনএফডিসি-র কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল, কম্পিউটারের পর্দায় এক আদিবাসীর মুখ। ‘অফ ভয়েস’-এ (নেপথ্য থেকে) একটি করে শব্দ হিন্দিতে উচ্চারণ করছেন দোভাষী। সেই শব্দটিই তাঁর নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গিতে উচ্চারণ করছেন ওই আদিবাসী। এক বার নয়, তিন-তিন বার। অর্ণববাবুর ব্যাখ্যা, কোনও শব্দ এক বার উচ্চারণ করলে যথাযথ প্রকাশটা বোঝা যায় না। শব্দটি ঠিক কোন অনুভূতির বাহক, এক বার বললে সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না বলেই তিন বার রেকর্ড করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট ভাষার ‘স্যাম্পেল’ বা ব্যক্তি-নমুনা হিসেবে বাছা হয়েছে দু’জন পুরুষ এবং দু’জন মহিলাকে। ওই পুরুষ এবং মহিলাদের আবার ভাগ করা হচ্ছে প়়ঞ্চাশোর্ধ্ব ও পঞ্চাশের নীচের বয়স অনুযায়ী।
এই বয়স-ভিত্তিক বিভাজন কেন?
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার উপরে দখল এবং তার উচ্চারণও পাল্টে যায়। তাই এই বিভাজনে বয়সটাকেই ভিত্তি করেছেন উদ্যোক্তারা।
ওই সব ভাষার বেশ কয়েকটিরই বক্তা না-পাওয়ায় মুশকিল হচ্ছে। আবার মাওবাদী প্রভাবিত এলাকায় ঢুকে বক্তা খোঁজার সমস্যাটাও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই প্রকল্পের কাজে। তবে সব বাধা পেরিয়ে চলতি মাসেই প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছে এনএফডিসি।
শুধু ভারত নয়, অসংখ্য ভাষার অস্তিত্ব-সঙ্কট চলছে সারা বিশ্বেই। ‘বড়’ ভাষার মাত্স্যন্যায়ে তথাকথিত ছোট ভাষার এই মরণবাঁচন সঙ্কটের কারণ হিসেবে ‘কালচারাল র্যাগিং’কে চিহ্নিত করছেন ভাষাবিদ পশুপতিপ্রসাদ মাহাত। উদাহরণ হিসেবে নিজের মাতৃভাষার সমস্যার কথা বলছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমার ভাষা তো ছিল কোরমালি। কিন্তু ছোট থেকে বাংলা শিখেছি। ফলত আমার ভাষাটা কালচারাল সাইলেন্সের (সাংস্কৃতিক স্তব্ধতার) দিকে চলে গেল। এ ভাবেই তো বিপন্নতার মুখে পড়ছে ভাষারা।’’ ভাষা সংরক্ষণের বিষয়টিকে সরকারের যথোচিত গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। পশুপতিবাবু জানান, ওই সমীক্ষার ভাষাগুলি ছাড়াও জঙ্গলমহলের আদিবাসীদের ভাষা কোরমালি, লোধা-শবরদের ভাষা, চা-বাগানের আদিবাসী ভাষা রাভা বিপদের মুখে।
‘বড়’ ভাষার প্রতাপ অনেক ভাষার বিপন্নতার কারণ বলে মনে করেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকারও। কিন্তু ভাষা ছোট না বড়— এই সিদ্ধান্ত নেবে কারা? পবিত্রবাবু বলেন, ‘‘ক্ষমতাই এই মাপকাঠি ঠিক করে দেয়। প্রশাসন কোন ভাষাকে গুরত্ব দিচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে সেটাই নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। যে-ভাষা আমাকে আর্থিক উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় ‘কিলিং ল্যাঙ্গুয়েজ’। ধীরে ধীরে সে মেরে ফেলে ছোট ভাষাদের।’’
তা হলে ভাষার এই দাদাগিরি রুখে দাঁড়ানোর উপায় কী?
‘‘আটকানোর উপায় নেই,’’ বলছেন পবিত্রবাবু। তবে সংরক্ষণের উপরে জোর দেওয়ার কথা বলছেন তিনিও। কিন্তু সংরক্ষণ হবে কী ভাবে? সাঁওতালি, চাকমা, মিজো প্রভৃতি ভাষা এখন বিভিন্ন পাঠ্যক্রমে পড়ানো হয়। এটা কি বিপন্ন ভাষাকে বাঁচানোর পথ হতে পারে? পারে না বলেই মনে করেন পবিত্রবাবু। তাঁর বক্তব্য, পাঠ্যক্রমে ওই সব ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করলে সেটা শেষ পর্যন্ত পড়ুয়াদের উপরে চাপ বাড়িয়ে দেবে।
তা হলে সংরক্ষণ হবে কী ভাবে?
এনএফডিসি-র উদ্যোগে আশা দেখছেন পবিত্রবাবু। তিনি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কিছু কিছু কেন্দ্র খুলে বিপন্ন ভাষাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। সেটাও একটা পথ।
বিপদ যে দোরগোড়ায় হাজির, সেই বিষয়েও সতর্ক করে দিচ্ছেন পবিত্রবাবু। তিনি জানান, লুপ্তপ্রায় ভাষাগুচ্ছের বিপন্নতা থেকে বাংলা নিরাপদ দূরত্বে আছে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। আশঙ্কার শিকড় ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাতেও। অন্যান্য ভাষার প্রতি বাংলাভাষীদের দুর্নিবার আকর্ষণ এবং হোয়াটস অ্যাপ, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের অনিবার্যতা এক অদ্ভুত মিশ্র ভাষায় পরিণত করেছে বাংলাকে। এই পরিস্থিতিতে অদূর ভবিষ্যতে বিপন্ন ভাষার তালিকায় বাংলারও ঠাঁই হতে চলেছে কি না, এখন সেই প্রশ্ন ভাবাচ্ছে ভাষাপ্রেমীদের।