ছবি: পিটিআই।
পুড়ে খাক পুরো কারখানা। ছাই মনও। সেই গুঁড়িয়ে যাওয়া ছাদ, কালো দেওয়াল, ভাঙা বুক আর খানকয়েক আধপোড়া রিকশার কঙ্কালের মধ্যে মাথায় হাত দিয়ে বসে ওঁরা দু’জন— মহম্মদ সাবির আর হরি ওম।
মঙ্গলবার ভরদুপুরে সংঘর্ষ-বিধ্বস্ত শিব বিহারের চুনাভাট্টিতে দু’জনের চোখেই শূন্য দৃষ্টি। সাবির বললেন, ‘‘আজ বহু বছর রিকশা তৈরি করে ভাড়া খাটাই। গত মঙ্গলবার রাতেও এখানে ৭০টি রিকশা রাখা ছিল। ১৬টি জ্বালিয়ে দিয়েছে। লুট হয়েছে বাকিগুলি! প্রাণে বেঁচে গিয়েছি, এই না কত!’’
শিব বিহার লাগোয়া মুস্তাফাবাদের বাসিন্দা সাবিরের কাছ থেকে রিকশা নিয়ে যাঁরা রোজ চালান, তাঁদের অধিকাংশই হিন্দু। যেমন, হরি ওম। আদতে শাহজহানপুরের বাসিন্দা হরি পেটের দায়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন এখানে। পোড়া রিকশা পেশা কেড়েছে। ছাড় পেয়েছে প্রাণটুকু। সংঘর্ষের সাত দিনের মাথায় দু’জনেরই বক্তব্য, ‘‘বরবাদ হো গ্যয়ে।’’ তা হলে আদতে লাভ কার হল? কে জানে!
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজই বলেছেন, ‘‘আমার একমাত্র লক্ষ্য উন্নয়ন। যার প্রাক্-শর্ত শান্তি, ঐক্য ও সম্প্রীতি। এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করতে নেতৃত্ব দিতে হবে সব সাংসদকে।’’ এত দুঃখেও যা শুনে ম্লান হাসলেন গৌরব ধল্লা, পাপ্পু ভাইয়ারা।
দমকলের জলে এ চত্বরের বাড়ি-দোকান-গ্যারাজের আগুন হয়তো নিভেছে। কিন্তু প্রশাসনের উপরে ক্ষোভে জ্বলছেন সাধারণ মানুষ। পাপ্পু বলছিলেন, ‘‘হিন্দু মহল্লায় আজ বহু দিন ঠেলাগাড়ি তৈরির কাজ করি। যাঁরা ঠেলা চালান, তাঁরাও অধিকাংশ হিন্দু। এসে দেখুন, গ্যারাজের ১২০টির মধ্যে মেরেকেটে ৩০টি ঠেলা বেঁচে। বাকি সব লুট হয়েছে কিংবা গিয়েছে আগুনের পেটে। ওই ক’টিও বেঁচেছে আশপাশের হিন্দুদের জন্য। গোলমাল তো করে গিয়েছে বাইরের লোক।’’ তাঁর প্রশ্ন, এত লোক বাইরে থেকে এসে তাণ্ডব চালিয়ে গেল। এত খুন, রক্ত। পুলিশ কোথায় ছিল প্রথম দু’দিন?
শিব বিহারের রাস্তা এখন পুলিশ-র্যাফ-সিআরপিএফে ছয়লাপ। সে দিকে আঙুল তুলে গৌরব ধল্লার অভিযোগ, ‘‘আমার শো-রুমের পাশের তেতলা বাড়িরই হাল দেখুন। একতলার আসবাবের দোকান জ্বলেপুড়ে শেষ। দোতলা পাথরে চুরমার। তেতলার কোচিং ক্লাস থেকে কোনও ক্রমে বার করা গিয়েছিল পড়ুয়াদের। অজস্র বার পুলিশে ফোন করা হয়েছে। ডাকা হয়েছে দমকলকে। কারও টিকি দেখা যায়নি। ভোট চাইতে লজ্জা হয় না রাজনৈতিক নেতাদের?’’
সংঘর্ষের সাত দিন পরেও শিব বিহার-মুস্তাফাবাদে চক্কর কাটলে দেখা যাবে, কোথাও গলায় গুলি প্রাণ কেড়েছে হিন্দু তরুণের, কোথাও মৃত সন্তানের জন্য মুসলিম মহিলার হাহাকার। কোথাও পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া স্কুল, কোথাও কাচ গুঁড়িয়ে যাওয়া শো-রুম। কোথাও র্যাফের টহল, কোথাও ঊর্ধ্বশ্বাসে লোক ছুটছেন নালায় আধপোড়া দেহ মিলেছে শুনে। সত্যি খবর কি না, জানেন না। কিন্তু যদি পরিচিত কেউ হয়! স্থানীয়দের একাংশ অবশ্য দাবি করেছেন, তল্লাট থেকে এখনও অনেক মৃতদেহ বেরোনো বাকি।
ই-রিকশার চালক রাহুল অবশ্য বললেন, ‘‘এই যে বেশ কিছু দোকানপাট খোলা দেখছেন, গাড়ির দেখা মিলছে রাস্তায়— দিন কয়েক আগে এ-সবও বন্ধ ছিল।’’ ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল, মিষ্টির দোকানে সামান্য বিক্রিবাটা শুরু হয়েছে। সাজছে বিয়ের মণ্ডপ। গোটা কয়েক বিউটি পার্লারও ঝাঁপ খুলেছে। হয়তো সে কারণে এই এলাকা আজ ঘুরে গেলেন উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়া।
তবে ‘ধর্মের নামে যুদ্ধে’ যাঁদের সব গিয়েছে, ত্রাণ আর খাবারের গাড়ি এলে, লম্বা লাইন দিচ্ছেন তাঁরা। অধিকাংশই মহিলা। এমন এক ‘সরকারি’ ট্রাকের দরজায় আবার লেখা— ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও!’