Delhi Assembly Election 2020

‘নামপে’ ভোট? নাকি ‘কামপে’? এক প্রশ্নই ঘায়েল করে দিল বিজেপি-কে

আর ‘কাম’ মানে অরবিন্দ কেজরীবাল। কারণ নিজের নামে নয়, আম আদমি পার্টির নামে নয়, গোটা প্রচার পর্বটায় শুধু ‘কাম’-এর (কাজ) নামে ভোট চেয়ে গিয়েছেন তিনি।

Advertisement

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৩:০৫
Share:

ভোটপ্রচারে অরবিন্দ কেজরীবাল।ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া।

এই ভোটের কিছু দিন আগে থেকে দিল্লিতে একটা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছিল প্রায় স্লোগানের প্রাবল্যে। স্লোগান না বলে ক্যাচলাইনও বলা যেতে পারে। প্রশ্নটা হল— দাম কাকে দেবেন? ‘নাম’কে, না ‘কাম’কে?

Advertisement

‘নাম’ অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী। তাঁর নামেই নাকি সব সম্ভব (মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়)!

আর ‘কাম’ মানে অরবিন্দ কেজরীবাল। কারণ নিজের নামে নয়, আম আদমি পার্টির নামে নয়, গোটা প্রচার পর্বটায় শুধু ‘কাম’-এর (কাজ) নামে ভোট চেয়ে গিয়েছেন তিনি। গত পাঁচ বছরে দিল্লিতে যা কিছু করেছে তাঁর সরকার, তা ভোটে জেতার জন্য যথেষ্ট বলে বিশ্বাস ছিল কেজরীবালের।

Advertisement

দিল্লি ভোটের ক্যাচলাইন হয়ে ওঠা ওই প্রশ্নটার জবাব আজ সবার সামনে। তবে স্লোগান বা ক্যাচলাইন, যা-ই বলা হোক না কেন, প্রশ্নটার সূত্রপাত কিন্তু আম আদমি পার্টির (আপ) হাত ধরেই। গত পাঁচ বছরে নিজেদের সরকারের কাজের খতিয়ান নিয়ে আপ কর্মীরা যখন থেকে ভোটারদের দরজায় দরজায় যেতে শুরু করলেন, তখন থেকেই এই স্লোগান সুলভ প্রশ্নটা সামনে উঠে আসতে শুরু করে। নিখরচায় বিদ্যুৎ, সরকারি খরচে স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিনামূল্যে জল, বিনামূল্যে সরকারি বাসে মহিলাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা— এ সব কথাই বার বার ভোটারদের সামনে গিয়ে বলছিল আপ। আর তার পরেই প্রশ্ন তুলছিল, এই সব ‘কাজ’ দেখে জনতা ভোট দেবেন? নাকি কারও ‘নাম’ দেখে ভোট দেবেন?

আরও পড়ুন:গেরুয়া ফাঁদে পা দিতে গিয়েও সামলে নিলেন কেজরী, টেনে কি ধরলেন পিকে?

এই কাজগুলোর বেশ কয়েকটা কিন্তু আপের গত বারের নির্বাচনী ইস্তাহারে ছিল। ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেই আপ সুপ্রিমো নেতা তথা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ, রোজ ৭০০ লিটার পর্যন্ত জল বিনামূল্যে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবেন। সে প্রতিশ্রুতি তিনি রেখেছেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তাঁর ‘মহল্লা ক্লিনিক’ প্রকল্প কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মান ভারত’কে প্রায় টেক্কা দিয়ে গিয়েছে বলে আপের দাবি। এ বারের প্রচার পর্বে নিজের ভাষণগুলোয় কেজরীবাল বার বারই সে কথা দিল্লির মানুষদের মনে করিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা ভোট চাইতে আসবেন, তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন যে, তাঁদের রাজ্যে সাধারণ মানুষ কি এই সুবিধা পান?’’ নাম না করলেও নিশানা যে অমিত শাহ, স্পষ্ট করে না বললেও প্রশ্ন যে মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাতে বিদ্যুতের দাম নিয়ে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়নি।

কেজরীবালের অন্যতম ভরসা মনীশ সিসৌদিয়া। ছবি ফেসবুুক থেকে নেওয়া

তবে দিল্লিবাসীদের অনেকে যেমন এ সব প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন, তেমন মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত যে এ সব প্রকল্পের সুবিধা পাননি, তা-ও কিন্তু ঠিক। সে প্রসঙ্গে একটা কথাও কিন্তু কেজরীবাল বা আপ নেতা-কর্মীরা বলেননি। আপের শাসনে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের আদৌ কোনও সুবিধা হয়েছে কি না বা মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের দেওয়া করের অর্থে অন্যদের সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে কি না— সে সব প্রশ্নের উত্তর সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন কেজরীবাল। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আরও একটা প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন। গত ভোটের আগে তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল ৮ লক্ষ চাকরি দেওয়ার। তার কী হল? কেজরী বা তাঁর দল উত্তর দেয়নি। দিল্লির দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রশ্নেও কেজরীবাল ব্যর্থই হয়েছেন।

কিন্তু আম আদমি পার্টির বাঁধা ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে যাঁরা পরিচিত হয়ে উঠেছেন গত কিছু বছরে, দিল্লির বিভিন্ন ‘ঝুগ্গি-ঝোপড়ি’র সেই অজস্র বাসিন্দা কিন্তু কর্মসংস্থান বা দূষণ বা ভর্তুকি সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাতে চাননি। ফলে বাঁধা ভোট সামলে রাখতে পেরেছেন কেজরীবাল। আর এক সময়ে বিজেপি-র বাঁধা ভোট হিসেবে যাঁরা পরিচিত ছিলেন, সেই ছোট দোকনদার বা ছোট ব্যবসায়ীরাও নোটবন্দি বা জিএসটি নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন বিজেপির উপরে। তাঁদের ভোটও অনেকাংশেই গিয়েছে কেজরীবালের দিকে।

দিল্লির ময়দান কি তা হলে একেবারেই ফাঁকা ছিল কেজরীবালের জন্য? না, তা একেবারেই ছিল না। বিজেপি-ও নিজের পছন্দের হাতিয়ার নিয়ে মাঠে নেমেছিল। সিএএ, এনআরসি, শাহিন বাগের মতো বিষয় নিয়ে সুর ক্রমশ চড়াতে চড়াতে কেজরীবালকে বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিল বিজেপি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য কেজরীবালের বিকল্প মুখ হিসেবে নিজেদের শিবির থেকে কাউকে তুলে ধরতে বিজেপি পারেনি। ভরসা রেখেছিল সেই একটাই নামে— নরেন্দ্র মোদী। আর সেখানেই অনেকে পাল্টা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন— বিজেপি যদি জেতে, তা হলে মোদী কি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হতে আসবেন? যদি না আসতে পারেন, তা হলে মোদীর নামে ভোট চাওয়া কেন?

আপ সমর্থকদের মুখে হাসি। ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া।

ভোটের পরে সময় দেওয়া তো অনেক দূরের কথা, মোদী কিন্তু ভোটের আগেও দিল্লির জন্য খুব বেশি সময় ব্যয় করতে পারেননি। তিনি দুটোর বেশি সভা করতে পারেননি দিল্লিতে। দলের প্রাক্তন ও বর্তমান সভাপতি অমিত শাহ এবং জে পি নড্ডার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল দিল্লি দখল করার ভার। অমিত শাহ ঘূর্ণির মতন ছুটে বেড়িয়ে ৪৭টা নির্বাচনী সভা করেন দিল্লিতে। আর নড্ডা করেন ৪০টা। কিন্তু তাঁদের ভাষণেও কেজরীবালের বিরুদ্ধে আক্রমণ কিন্তু খুব ধারালো ছিল না। শাহিন বাগে চলতে থাকা সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ নিয়ে নানা কথা বিজেপি নেতারা বলছিলেন ঠিকই, কিন্তু দিল্লি পুলিশ অমিত শাহের নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা সত্ত্বেও বিক্ষোভকারীদের রাস্তা থেকে সরানোর জন্য কোনও পদক্ষেপ করেনি। অতএব শাহিন বাগে রাস্তা আটকে থাকা নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ থাকলেও, তা থেকে বিজেপি লাভ তুলতে পারেনি।

আরও পড়ুন:গণনা শেষ হওয়ার আগেই উচ্ছ্বাসে ভেসে গেলেন আপ-কর্মী ও সমর্থকরা

অতএব, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ডের পরে এ বার দিল্লিতেও হারতে হল বিজেপি-কে। বিজেপির এই অবস্থা কেন? কেন্দ্রে এত মজবুত সরকার থাকা সত্ত্বেও একের পর এক রাজ্য হাতছাড়া কেন? মরিয়া হয়ে ময়দানে নামার পরেও দিল্লি জেতা গেল না কেন? তার কারণ, প্রথমত, আপের তোলা কৌশলী স্লোগান। দ্বিতীয়ত, ভোটাররা জানেন যে, নিজের এলাকার জন্য বা একেবারে ব্যক্তিগত স্তরের কোনও চাহিদার জন্য কিছু চাইতে হলে, কেন্দ্রের কাছে চাওয়া যাবে না। চাইতে হবে রাজ্য সরকারের কাছেই। আর এই ধরনের চাহিদা মেটানোর জন্য আপ সরকারের জুড়ি মেলা ভার।

দিল্লির ক্ষেত্রে দেখা গেল, এ বার ভোটের হার আগের বারের চেয়ে কম। আপের দুর্গ হিসেবে পরিচিত যে সব এলাকা, সেখানে বরং ভোটের হার বেশি। তা হলে কি বিজেপির ভোট ম্যানেজাররা অথবা আরএসএস ব্যর্থ হল? অনুগত ভোটারদের কি তারা বুথ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারল না? ভোটের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই ছবিটাই বাস্তব ছিল। বেগতিক বুঝে ক্রাইসিস ম্যানেজাররা মরিয়া হয়ে মাঠে নামেন। অনুগত ভোটব্যাঙ্ক ঝেঁটিয়ে ভোটারদের বুথে নিয়ে যেতে শুরু করেন। ফলে বিকেল ৪টের পরে ভোটদানের হার প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। কিন্তু তাতেও যে বিজেপির শেষ রক্ষা হল না, ফল প্রকাশের পরে তা স্পষ্ট হয়ে গেল।

দিল্লি কিন্তু এখনও পূর্ণাঙ্গ রাজ্য নয়। দিল্লির সরকার চালাতে মুখ্যমন্ত্রীকে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে কেন্দ্রে যদি বন্ধু সরকার না থাকে। বিজেপি সে কথা বার বার মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল প্রচার পর্বে। তবে ফল দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দিল্লির ভোটাররা তাতে বিশেষ গুরুত্ব দেননি।

লেখক: দিল্লিবাসী বর্ষীয়ান সাংবাদিক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement