National news

‘শিশু ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ড মেরে ফেলার প্রবণতা বাড়াবে’

নির্ভয়ার পরে কাঠুয়া-উন্নাও-সুরাত আবার দেশজোড়া একরকম প্রতিবাদ, ক্ষোভ, হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই পাঁচ বছর নিয়ে অনেকগুলি রিপোর্ট সামনে এসেছে।

Advertisement

শাশ্বতী ঘোষ

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:৫৪
Share:

কাঠুয়া কাণ্ডের প্রতিবাদ। ছবি: পিটিআই।

কাঠুয়া-উন্নাও-সুরাত। একটি যেন আর একটিতে নৃশংসতায়, অধিকার হরণের মাত্রায় ছাপিয়ে যাচ্ছে। নারী নিগ্রহ কি বাড়ছে? না কি রিপোর্টিং বাড়ছে? যে কোনও দিকেই এটা প্রমাণ করা খুব কঠিন, আপনি সরকারের দিকে হলে বলবেন, ঘটনা বাড়ছে না। সরকার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করছে বলে রিপোর্টিং বাড়ছে। আবার আপনি বিরোধীদের দিকে ঢলে খাকলে বলবেন, ঘটনাই বাড়ছে। যাই হোক, তথ্যপ্রমাণ না থাকায় ধরে নিচ্ছি দুটোই বাড়ছে, রিপোর্টিং এবং ঘটনাও। আমরা জানি যে, যতই বেটিদের বাঁচানোর কথা বলা হোক না কেন, বেটিদের বাঁচা বেশ কঠিন। আর মরলে বা নিগৃহীত হলে বিচার পাওয়া শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন উঠবে, এই নির্ভয়ার ঘটনার পর আইনে এত বদল হল, এত নতুন আইন হল, এত কড়াকড়ি হল, তা হলেও নিগ্রহ কেন বাড়ছে? আইনগুলি বাস্তবে কতটা প্রয়োগ হচ্ছে? না কি সবই খাতায়কলমে? পাঁচ বছর পেরিয়ে এই হিসেবনিকেশ জরুরি।

Advertisement

নির্ভয়ার পরে কাঠুয়া-উন্নাও-সুরাত আবার দেশজোড়া একরকম প্রতিবাদ, ক্ষোভ, হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই পাঁচ বছর নিয়ে অনেকগুলি রিপোর্ট সামনে এসেছে। তার মধ্যে রয়টার্স তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগ ৬০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার। এর মধ্যে শিশুদের উপর অত্যাচারের ঘটনা ৪০ শতাংশ। কিন্তু সব মিলিয়ে শাস্তির হার মাত্র ২৫ শতাংশ। ২০১৬-র শেষে এক লক্ষ ৩৩ হাজার মামলা বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে রয়েছে। কেন? প্রথমত, পুলিশ পর্যাপ্ত নেই। ২০ লক্ষ আধিকারিক প্রয়োজন। চারটির মধ্যে একটি পদ ফাঁকা। ফলে এই সময়ে মোট দায়ের হওেয়া অভিযোগের প্রতি তিনটিতে একটি পুলিশ তদন্ত করেছে, বাকিগুলির ফাইল চুপচাপ বন্ধ হয়ে গেছে। আর পুলিশি দক্ষতার অভাবেই যে শুধু তদন্ত হয়নি তা নয়, বহু সময় পছন্দসই রিপোর্ট না হলে স্থানীয় রাজনীতিকরা পুলিশকে বদলির হুমকি দেন। তাই পুলিশরা অনেক সময় চাপে মিথ্যে রিপোর্ট দাখিল করে, কাঠুয়া-উন্নাও তার উদাহরণ।

টালবাহানায় শুধু তদন্ত অসমাপ্ত থাকে তাই নয়, বিচারব্যবস্থাতেও পরিকাঠামোর অভাব, তাই যে মামলাগুলি আদালত পর্যন্ত এল, তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ মামলা সে বছর শোনা হবে না, পরের বছরের মামলার পাহাড়ে যোগ হবে। যেমন শিশুদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন যৌননিগ্রহের অপরাধে শাস্তি দেওয়া যদি চলতি হারেই চলে, তা হলে সব মামলার রায় দিতে দু’দশক পেরিয়ে যাবে। বর্তমানে শাস্তির হার কমতে থাকলেও বাড়ছে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রবণতা, শুধু ২০১৭ সালেই ধর্ষণ করে খুন, প্রভৃতি অপরাধের জন্য ৪৩ জন মৃত্যুদণ্ড পেয়েছে, যা আগের বছরের দু’গুণ। শ্লথ তদন্ত আর বিচারব্যবস্থার সঙ্গী যদি ব্যাপক হারে মৃত্যুদণ্ড হয় তা বিশেষ চিন্তার বিষয়। বিশেষত, পকসো আইনে নিগৃহীতার বয়স ১২ বছরের নীচে হলে মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব দিয়েছেন নারী ও শিশুকল্যাণমন্ত্রী মেনকা গাঁধী— সেই প্রস্তাব ধরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা শনিবারই অর্ডিন্যান্স পাশ করে দিল। একে শাস্তির হার কমছে, তার পাশাপাশি এই অর্ডিন্যান্স পাশ হওয়াটা খুবই চিন্তার বিষয়। প্রথমত, সে ক্ষেত্রে নাবালিকার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে যায়, এই ঘটনায় নিগৃহীতাই প্রধান সাক্ষী, কিন্তু মৃত্যুদণ্ড সুনিশ্চিত হলে নাবালিকাকে হত্যার আশঙ্কা বাড়ে। দ্বিতীয়ত, ধর্ষণ করলে যেন মনে করা হচ্ছে, মেয়েটিকে প্রকৃত অর্থে হত্যা করা হয়েছে। অতএব, অভিযুক্তের একমাত্র শাস্তি হল হত্যা। বলে রাখা হল, ধর্ষণের সঙ্গে হত্যার ঘটনা ঘটলে সে ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের কথা ভাবা যেতেই পারে। কিন্তু এই সংশোধন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পাশের আগেই কার্যকর হয়ে গিয়েছিল কয়েকটি রাজ্যে, বাকি অনেক রাজ্যও এই বদলের কথা ভাবছিল।

Advertisement

উন্নাও ও কাঠুয়া কাণ্ডের প্রতিবাদ অমৃতসরে। ছবি: রয়টার্স।

আরও পড়ুন: নির্ভয়ার আর্তনাদেও ঘুম ভাঙেনি! ধর্ষণ বেড়েই চলেছে দেশে

আরও পড়ুন: শিশু ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ড, অর্ডিন্যান্স পাশ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়

ঘটনা বাড়ছে।

শাস্তি কমছে।

নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বাড়ছে।

এই তিনটি তথ্য পাশাপাশি রাখলে কিন্তু সুবিচারের ছবি স্পষ্ট করে না। কারণ, কয়েক জন অপরাধী নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডের মতো চূড়ান্ত শাস্তি পেলেও বাকিরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে, নিগৃহীতা আর সাক্ষীদের ভয় দেখাচ্ছে, বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে। বেশির ভাগ নিগৃহীতা আর তাঁদের পরিজনরা কুঁকড়ে, ভয় পেয়ে জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন।

আমরা যদি যৌন আক্রমণে রাশ টানতে সক্ষম না-ও হই, যাতে তাঁরা সুবিচার পান এবং দ্রুত পান সেটুকু সুনিশ্চিত করি। তার জন্য যা বরাদ্দ, সেটুকু বাজেটে রাখি আর খরচ করি। নির্ভয়া তহবিল ব্যবহার করে হেল্পলাইন, নিগৃহীতাদের পুনর্বাসন আর এক ছাদের তলায় হাসপাতাল, পুলিশ আর আদালতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের জন্য সব ব্যবস্থা, ‘ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার’ (ওএসসিসি) করার কথা। নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক বলছে, ২২টি রাজ্যে এ ধরনের হেল্পলাইন কাজ করছে, কিন্তু সহায়তা চাইতে গেলে দেখা যাচ্ছে, সেগুলি ঠিকমতো কাজ করছে না। বহু অভিযোগ একসঙ্গে এলে সেগুলি নিরসনের মতো পরিকাঠামোই নেই। ২০১৫ সালে রাজ্য সরকারগুলির তহবিলের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নিগৃহীতা পুনর্বাসন তহবিলে ২০০ কোটি টাকার ব্যবস্থা করা হয়। ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে নিগৃহীত শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য তহবিলের কথা বলা হল। কিন্তু সে তহবিল পাওয়ার পথ কী, জানা দুরূহ।

এগুলি বাস্তবায়িত হলে তার পর দেখব তাতেও নারী নিগ্রহ কমল কি না, না হলে নির্ভয়ার পাঁচ বছর পরে কাঠুয়া-উন্নাও-সুরাতের ঘটনা কতটা কী এগোল তার হিসেবনিকেশ আমাদের ব্যস্ত করে দিয়েছে, আরও পাঁচ বছর পরে আবারও অন্য কোনও জায়গার নাম করে আমরা নারী নিগ্রহের হিসেবই করে যাব, আর দেখব হাতে শুধুই পেন্সিল রইল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement