জল-যান। মুম্বইয়ের রাস্তায় ডুবেছে ট্যাক্সি। কোমর-জল ঠেলেই যাতায়াত পথচারীদের। শুক্রবার। ছবি: এএফপি।
লাইন ডুবে থমকে লোকাল ট্রেন। আধডোবা বাস, গাড়ি। হাঁটুজল পেরিয়ে বাড়ি ফিরছেন অফিসযাত্রীরা। রাস্তায় উল্টেছে গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি। বর্ষা নামতে না নামতেই ফিরে এল চেনা ছবিগুলো!
এমনিতে দশ দিনে যতটা বৃষ্টি হওয়ার কথা, গত ২৪ ঘণ্টায় তার চেয়েও বেশি বৃষ্টি হয়েছে মুম্বইয়ে। হাওয়া অফিস বলছে, শুধুমাত্র শহরেই বৃষ্টির পরিমাণ ছিল ২৮৩ মিলিমিটার। কোঙ্কন উপকূল আর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বৃষ্টি হয়েছে ১৫২-১৮৮ মিলিমিটার পর্যন্ত। বিপদ সীমার উপরে বইছে মিঠি নদী। মধ্য মুম্বইয়ের ওয়াডালায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে এক শিশু ও এক প্রৌঢ়ার।
অবিরাম বৃষ্টিতে কার্যত বিপর্যস্ত জনজীবন। বাতিল করা হয়েছে মুম্বইয়ের সেন্ট্রাল ও হারবার লাইনে লোকাল ট্রেন চলাচল। ব্যাহত সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থাও। ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই ফিরতে বাধ্য হয়েছে ইন্ডিগো, জেট এয়ারওয়েজ-এর তিনটি বিমান। সেগুলির মধ্যে দু’টি ফিরে গিয়েছে আমদাবাদে আর একটি বডোদরায়। লাইন ডুবে থাকায় শহরের বাইরেই অপেক্ষায় থেকে গিয়েছে দূরপাল্লার ট্রেনগুলি।
বছর দশেক আগে একটানা ভারী বৃষ্টিতে একই ভাবে বানভাসি হয়েছিল বাণিজ্যনগরী। দু’দিনের তুমুল বৃষ্টি ফিরিয়ে দিচ্ছে সেই স্মৃতিই। বন্যা-পরিস্থিতি এড়ানোর জন্যই ফি-বছর মুম্বইয়ের নিকাশি খাতে কোটি কোটি খরচ করে সরকার। চলতি বছরও ওই খাতে ১৫০ কোটি বরাদ্দ করেছিল রাজ্যের শিবসেনা-বিজেপি জোট। মুম্বই ভাসতেই তাই সরব হয়েছেন বিরোধীরা। তাঁদের প্রশ্ন, সেই টাকা গেল কোথায়? উন্নয়নের খাতে বরাদ্দ টাকা নয়ছয়ের অভিযোগও আনছেন তাঁরা।
এরই মধ্যে আগামী আরও তিন দিন ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া দফতর। বিকেলের দিকে জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না তারা। অন্তত ৪-৫ মিটার উচ্চতার ঢেউ উপকূল এলাকায় আছড়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে শহরের নিচুএলাকাগুলি। জলে-জঞ্জালে থইথই পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কুর্লা, চেম্বুর, তিলকনগর, আন্ধেরি, পারেল, ঠাণে, নভি মুম্বই, ডোম্বিভেলি প্রভৃতি এলাকাও।
পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সকাল সকাল বৃহন্মুম্বই পুরসভার কন্ট্রোল রুমে হাজির হন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীস। সেখানেই মুখ্যসচিব এবং উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক সেরে ফেলেন তিনি। খুব দরকার না হলে মুম্বইবাসীকে আপাতত বাড়ির বাইরে বেরোতে বারণ করেছেন তিনি। পরিস্থিতি যুঝতে পুরসভার বিপর্যয় মোকাবিলা শাখার ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। ফডনবীসের দাবি, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর তৎপরতায় এড়ানো গিয়েছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। জল সরাতে ১৭৬টি পাম্প অবিরাম কাজ করেছে। মুম্বইয়ের মেট্রোপলিটান এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তরফে আগেভাগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সাতটি সাবস্টেশন। যার জেরে এড়ানো গিয়েছে শর্ট সার্কিটের মতো দুর্ঘটনা। তবে দীর্ঘ ক্ষণ বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হয় শহরবাসীকে।
বৃষ্টির জেরে বন্ধ ছিল হাইকোর্ট সমেত শহরের প্রতিটি আদালত। ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় স্কুল পড়ুয়াদেরও। মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে পিছিয়ে দেওয়া হয় ২০ জুনের স্নাতক আর স্নাতকোত্তর স্তরের প্রতিটি পরীক্ষা। যাতায়াতের মূল মাধ্যম লোকাল ট্রেন বাতিল হয়ে যাওয়ায় গন্তব্যে পৌঁছতে পারেননি অধিকাংশ অফিসযাত্রীই। যাঁদের না গেলেই নয়, সাইকেলের ভরসায় অফিস পৌঁছেছেন তাঁরা। অবশ্য দিন কেটেছে ছুটির মেজাজে।
বৃষ্টির জেরে ভেস্তে গিয়েছে শাসকদল শিবসেনার বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানও। ১৯ জুনই ছিল তাদের প্রতিষ্ঠা দিবস। দলের বিধায়ক সঞ্জয় রাউত বলেছেন, ‘‘অদূর ভবিষ্যতে এই আনন্দ অনুষ্ঠান আমরা আবার করতে পারব। তবে রাস্তায় নেমে মুম্বইবাসীকে সাহায্য করাটাই এখন প্রথম কাজ।’’ শিবসেনা আর যুবসেনার কর্মীদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। সঞ্জয় বলেছেন, পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে আগামী কাল দলীয় প্রধান উদ্ধব ঠাকরে আর তাঁর ছেলে আদিত্য গ্রেটার মুম্বই পুরসভার বির্পযয় মোকাবিলা বাহিনীর সঙ্গে দেখা করবেন।
বৃষ্টি-বিপাকে বলিউডও। শ্যুটিং স্পটে পৌঁছতেই কাহিল হয়ে পড়েন তাঁদের অনেকে। বলিউড তারকাদের পোস্ট ছেয়ে যায় টুইটার, ফেসবুকের ওয়ালে। মুম্বইয়ের পরিকাঠামো ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ উগরে ফারহান আখতার বলেন, ‘‘আমার মনে হয় সাধারণ মানুষের করের টাকা জমা জল সরানোর কাজে নয় বরং জল জমানোর কাজে ব্যবহার হচ্ছে।’’ টুইটারে সোনাক্ষী লেখেন, ‘‘পুরোটাই ভূতুড়ে পরিস্থিতি,’’ কুণাল খেমু বলেন, ‘‘যাচ্ছি গাড়িতে হয়তো ফিরব নৌকোয়।’’ চিত্রপরিচালক অভিনব সিনহা বলেন, ‘‘২৫ বছর মুম্বইয়ে আছি। প্রতি বছর এক ছবি। রাজনীতিকরা প্রতিশ্রুতি দেন, তবে পরিস্থিতির বদল হয় না।’’
ইতিমধ্যে টুইটারে বৃষ্টির একটি ভিডিও-ও পোস্ট করেন বিপাশা বসু। লেখেন, ‘‘চোখের সামনে দেখলাম মুম্বইয়ের রাস্তা ভেনিস হয়ে গিয়েছে। গাড়িতে তখন বাজছে ম্যায় পরেশান, পরেশান।’’
সত্যিই পরেশান বৃষ্টি-বিধ্বস্ত মুম্বইকররা।