ভোটের আগে লখনউয়ের সিপিএম দফতরে।— নিজস্ব চিত্র
দশ নম্বর বিধানসভা মার্গ। বাড়িটার গেটের সামনে ফুচকাওয়ালাকে ঘিরে জটলা। সামনের দেওয়াল জুড়ে অখিলেশ যাদবের হাসি মুখের ছবি। তবে একতলা বাড়িটার ভিতরটা যেন কেমন। ঘরগুলিতে আলো ঢোকে কম। দিনের বেলাতেও হলদেটে বাল্ব জ্বলছে। চারপাশে ছড়িয়ে ধূলো ভর্তি ‘লোকলহর’-এর ফাইল, পুরনো বইপত্র, মার্ক্স-লেনিনের ছবি।
এটি একটি পার্টি অফিস। উত্তরপ্রদেশের ভোট দোরগোড়ায়, কিন্তু এখানে কোনও ব্যস্ততা নেই। ছড়িয়ে থাকা বইপত্র, নিভু নিভু আলো আর পুরনো কিছু আসবাব ব্যস্ততাহীন অলস সময় কাটাচ্ছে যেন। এমনকী কোনও নেতারও দেখা মিলল না। নেতাদের খোঁজ করতে শীর্ণকায় এক ব্যক্তি খিড়কির দরজা দেখিয়ে দিলেন। বাড়ির পিছনে এক চিলতে উঠোন। সেখানে কাগজি লেবুর গাছ। দড়িতে ঝুলছে ভেজা তোয়ালে, গেঞ্জি। পাঁচিলে লাল ঝাণ্ডা। শীতের রোদে বসে কমরেডরা খবরের কাগজ পড়ছেন।
সিপিএমের রাজ্য কমিটির অফিসের চেহারা আর উত্তরপ্রদেশে দলের অবস্থা পুরোপুরিই এক রকম। নেতারা কোনও দিকেই আলো দেখতে পাচ্ছেন না। বছর বছর ধরে সংগঠনের ধূলোমাখা দশা কিছুতেই কাটছে না।
উত্তরপ্রদেশের ভোটে ১৪০টি আসনে লড়ছে বামেরা। চার বাম দলের সঙ্গে রয়েছে এসইউসিআই, সিপিআই (এমএল) লিবারেশন। ২৬টি আসনে প্রার্থী দিচ্ছে সিপিএম। কিন্তু খালি হাতে ফিরতে হবে, তা-ও অজানা নয়। উত্তরপ্রদেশের জাত-পাত, ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিতে সিপিএমের শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্বের অবস্থা ভেজা তোয়ালের মতোই। রাজ্য কমিটির নেতা দীননাথ সিংহ যাদবের আফসোস, “এ রাজ্যে যাদব-মুসলমান-দলিত-ব্রাহ্মণ ভেদাভেদ করে ভোট টানার কৌশল ছাড়তে রাজি নয় কোনও দলই। কিন্তু কোনও দিনই আমরা ওই রাজনীতি করতে পারব না। সেখানেই আটকে যাচ্ছি।”
অতীতে অবশ্য এতটা খারাপ অবস্থা ছিল না। দীননাথ নিজে বিধায়ক ছিলেন। অনেক বছর ধরেই বামেরা বহু জায়গায় মুলায়ম সিংহ যাদবকে সাহায্য করতেন। এই করতে গিয়ে বাম নেতা-কর্মীদের অনেকেই মুলায়মের দলে নাম লেখান। অনেক পুরনো বাম নেতাই এখন সপা-র গুরুত্বপূর্ণ নেতা। আর সিপিএমের প্রভাব এখন এতটাই তলানিতে যে বিজেপির সঙ্গে লড়াইয়ে বামেদের পাশে ডাকারও প্রয়োজন বোধ করেন না অখিলেশ যাদব।
তবে সিপিএমের নেতারা বসে বসে দেখেন, তাঁদের পার্টি অফিসের পাশেই অখিলেশ যাদব নতুন মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয় তৈরি করিয়েছেন। সেই পাঁচতলা অট্টালিকা সিপিএমের দফতরে আলো ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে। সিপিএমের দফতরে বসে এক নেতার নালিশ, ‘‘অখিলেশ ছেলে ভালো। কাজও করেছে। কিন্তু তিনি মেরুকরণের রাজনীতির বিরোধিতা না করায় বিজেপির ফায়দা হয়েছে।’’
কার জন্য কার ফায়দা হল, এ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু একটা বিষয় জলের মতো স্পষ্ট, তা হল, বছর-বছর ধরে উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে সিপিএমের কোনও ফায়দা হয়নি। অনেকেই তাই বলেন, আর কবে হিন্দি বলয়ের রাজনীতির হেঁয়ালির উত্তর খুঁজে পাবে সিপিএম? দু বছর আগে পার্টি কংগ্রেসের সময় উত্তরপ্রদেশে দলের হাল নিয়ে কম কাদা ছোঁড়াছুড়ি হয়নি। কারণ প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ছিলেন উত্তরপ্রদেশের দায়িত্বে। সংগঠনের মুখ থুবড়ে পড়া, সদস্য সংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে তাঁর দিকেই আঙুল উঠেছিল। বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি মনে করেন, দু-একটি হলেও কিছু আসনে বামেরা লাগাতার জিতে আসছিল। কিন্তু দশ বছরে তা-ও হাতছাড়া হয়েছে। এখন সপা-কংগ্রেস জোটে যেচে নাম লেখানোরও মুখ নেই।
ইয়েচুরির মতে, এই মুহূর্তে উপায় একটাই। বারাণসীর মতো যে সব এলাকায় আগে বামেদের প্রভাব ছিল, সেখানে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। পলিটব্যুরো নেত্রী সুভাষিণী আলি উত্তরপ্রদেশে দায়িত্ব নিয়ে সেই চেষ্টা শুরু করেছেন। রাজ্য কমিটির দফতরের গায়েই মহিলা সমিতির অফিস তাই অনেক বেশি চনমনে।
দীননাথ বলেন, “চাষিদের সমস্যা নিয়ে জনমত গডে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। তবে এখন জাত-পাত, ধর্মের রাজনীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে টাকার খেলা। কোনও হিসেবই আর মেলে না।” মেলে না বলেই তিনি বিলক্ষণ জানেন, বিধানসভা ভবন রাস্তার উল্টোদিকে হলেও এ বারের ভোটেও সেখানে ঢোকার ছাড়পত্র মিলবে না।