নিজের ভুল মেনেও বুদ্ধকে বিঁধলেন কারাট

প্রকাশ কারাট রাজনৈতিক রণকৌশল মেনে কাজ করতে ভুল করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে বামফ্রন্ট সরকারের নীতিরও পর্যালোচনা দরকার। নিজেদের রাজনৈতিক রণকৌশলের পর্যালোচনা করতে বসে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছল সিপিএম। জাতীয় রাজনীতি থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সিপিএমের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার পিছনে যে তাঁর ভুল রয়েছে, তা মেনে নিলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক। সিপিএমের পার্টি দলিলেই এ বার বলা হল, পরমাণু চুক্তিতে সমর্থন প্রত্যাহার এবং তার পর ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে বিকল্প সরকার গঠনের ডাক দেওয়া ভুল হয়েছিল। দলের ‘রাজনৈতিক রণকৌশল’ অনুযায়ীই ওই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:১৭
Share:

প্রকাশ কারাট রাজনৈতিক রণকৌশল মেনে কাজ করতে ভুল করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে বামফ্রন্ট সরকারের নীতিরও পর্যালোচনা দরকার। নিজেদের রাজনৈতিক রণকৌশলের পর্যালোচনা করতে বসে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছল সিপিএম।

Advertisement

জাতীয় রাজনীতি থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সিপিএমের অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার পিছনে যে তাঁর ভুল রয়েছে, তা মেনে নিলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক। সিপিএমের পার্টি দলিলেই এ বার বলা হল, পরমাণু চুক্তিতে সমর্থন প্রত্যাহার এবং তার পর ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে বিকল্প সরকার গঠনের ডাক দেওয়া ভুল হয়েছিল। দলের ‘রাজনৈতিক রণকৌশল’ অনুযায়ীই ওই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।

সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে সরে যাওয়ার আগে কারাট এই ভুল স্বীকার করুন, এমনটাই চেয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। যার জন্যই তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে কারাটের দলিলের পাল্টা দলিল পেশ করেছিলেন। চাপের মুখে কারাট ভুল স্বীকার করেছেন। একই ভাবে এখন কংগ্রেসের জন্য দরজা বন্ধ করলেও প্রয়োজনে ভবিষ্যতে সেই দরজায় এক চিলতে ফাঁকও রাখা হয়েছে। এ সবের সঙ্গে সঙ্গেই নন্দীগ্রাম-সহ পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে যাওয়া যে ভুল হয়েছিল, সেটিও দলিলে লিপিবদ্ধ করে দিয়েছেন কারাট।

Advertisement

আগামী এপ্রিলে বিশাখাপত্তনমে পার্টি কংগ্রেসে আলোচনার জন্য আজ ‘রাজনৈতিক রণকৌশলের পর্যালোচনা রিপোর্ট’-এর খসড়া প্রকাশ করেছে সিপিএম। এই খসড়া রিপোর্ট নিয়ে এ বার দলের মধ্যে আলোচনা হবে। মনে করা হচ্ছে, এই রিপোর্টের বেশ কিছু বিষয় নিয়ে ফের বিতর্ক হবে। যার মধ্যে রয়েছে যুক্তফ্রন্ট সরকারে যোগ দেওয়া এবং প্রয়াত জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের প্রসঙ্গও। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার প্রস্তাব পেয়েও দলের একাংশের চাপে (যার মধ্যে ছিলেন প্রকাশ কারাটও) জ্যোতি বসুকে সেই প্রস্তাব ছাড়তে হয়েছিল। পরে তিনি একে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক রণকৌশলের পর্যালোচনা করতে বসে কারাট কিন্তু এখনও ওই সিদ্ধান্তকে ভুল বলে মানছেন না। উল্টে রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সমর্থন করতে গিয়েই দলের সমস্যা হয়েছে। যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদার আর্থিকনীতি থেকে সিপিএমের নিজস্ব অবস্থান যে আলাদা, তা বোঝানো যায়নি। ওই সময় সরকারকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে আন্দোলনেও নজর দেওয়া যায়নি।

২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যেও বামেদের ভরাডুবির পর থেকেই সিপিএমে বিতর্ক চলছে যে, ভুল কার। কারাট-শিবির আঙুল তুলেছে পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম অধ্যায়ের দিকে। সীতারাম ইয়েচুরির মতো কারাট-বিরোধী শিবির আবার কারাটের ইউপিএ থেকে সমর্থন প্রতাহারকে দায়ী করেছে। তার পরে পশ্চিমবঙ্গ, কেরলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত লোকসভা নির্বাচনে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সিপিএম। সাংগঠনিক জোর এবং সংসদে শক্তি কমে যাওয়ায় জাতীয় রাজনীতিতেও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে তারা। এই পরিস্থিতিতেই সিপিএম নেতৃত্ব এত দিনের রাজনৈতিক রণকৌশলের পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তা করতে গিয়েই দলে বিবাদের শুরু।

পর্যালোচনার প্রথম খসড়া রিপোর্টে পার্টির এখনকার কোণঠাসা অবস্থার জন্য পুরোপুরি রাজনৈতিক রণকৌশলকে দায়ী করা হয়। বলা হয়েছিল, ১৯৭৮ সালে জালন্ধর পার্টি কংগ্রেসে বাম ও গণতান্ত্রিক জোট তৈরির সিদ্ধান্ত থেকেই সব ভুলের শুরু। প্রথমে বাম গণতান্ত্রিক জোট, তার পরে কংগ্রেসের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে হাত মেলানো এ সব করতে গিয়েই পার্টির নিজস্ব শক্তি বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হয়নি। কিন্তু ইয়েচুরি পাল্টা নোট দিয়ে দাবি তোলেন, রাজনৈতিক রণকৌশলে ভুল ছিল না। দশ বছরে (যে সময় সাধারণ সম্পাদকের গদিতে প্রকাশ কারাট) সেই রাজনৈতিক রণকৌশল ঠিক মতো রূপায়ণ করা হয়নি। পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিতর্কের শেষে ইয়েচুরির যুক্তি অনেকটাই মেনে নিয়েছেন কারাট। দলিলে স্বীকার করা হয়েছে, ভুল সময়ে সমর্থন প্রত্যাহার হয়েছিল। আরও আগেই সমর্থন প্রত্যাহার করা উচিত ছিল।

কিন্তু নন্দীগ্রামের ভুল সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবের ফলে কৃষকদের থেকে পার্টি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।’ নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর কাণ্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাম বিদায়ের সূচনা হলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এখনও মনে করেন না যে, শিল্পায়নের নীতিতে কোনও ভুল ছিল। যা ভুল হয়েছিল, সেটা জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায়। দলিলে বলা হয়েছে, ‘নন্দীগ্রাম থেকে জাতীয় স্তরে বার্তা যায়, কর্পোরেটদের হয়ে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে পার্টিকে এর মূল্য চোকাতে হয়। জাতীয় স্তরেও পার্টির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।’ আর তাই বাম-জমানার শেষ দশ বছরের নীতি (যে সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে ছিলেন) খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেন্দ্রে যখন সরকার উদার অর্থনীতি নিয়ে চলছে, সে সময় কোনও রাজ্যে বাম সরকার কী নীতি নেবে, তা ঠিক করার জন্যই এই পর্যালোচনা প্রয়োজন।

খসড়া রিপোর্ট অনুযায়ী, এত দিনের রাজনৈতিক কৌশলের সবটাই ভুল ছিল, তা নয়। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়েই প্রথমে রাজীব গাঁধী, পরে নরসিংহ রাও সরকারের পতনে ভূমিকা নিয়েছে সিপিএম। ১৯৯৬ সালে বিজেপিকে রুখে দিয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার হয়েছে। ২০০৪ সালেও এনডিএ-সরকারের পতন ঘটানো গিয়েছে। ইউপিএ-সরকারকে সমর্থন করে একশো দিনের কাজের মতো জনমুখী প্রকল্প তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে সিপিএম।

কিন্তু কখনও বাম গণতান্ত্রিক জোট, কখনও তৃতীয় ফ্রন্ট, কখনও কংগ্রেসকে সমর্থন করতে গিয়ে সিপিএমের নিজস্ব শক্তি যে বিশেষ বাড়েনি, বিশেষত তিন রাজ্যের বাইরে তারা দুর্বলই রয়ে গিয়েছে, তা-ও মানছেন দলের নেতৃত্ব। দলিলে বলা হয়েছে, তৃতীয় ফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট এ সব শুধুই স্লোগান হয়ে থেকে গিয়েছে। দল ক্রমশ বুঝতে পেরেছে, এর কোনওটাই অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব নয়। কিন্তু মাঝখান থেকে দলের নিজস্ব শক্তি বাড়ানো, আন্দোলন থেকে নজর ঘুরে গিয়েছে।

এই পর্যালোচনা থেকে সিপিএমের সিদ্ধান্ত, দলের নিজস্ব শক্তি বাড়ানো, আন্দোলন তৈরি ও জনসমর্থন বাড়ানো ও বাম ঐক্য মজবুত করার দিকেই সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। নির্বাচনের রণকৌশলের ক্ষেত্রে বাম ও গণতান্ত্রিক জোটেই নজর থাকবে। তবে জাতীয় স্তরে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে কোনও জোট হবে না। কংগ্রেসের সঙ্গে তো নয়ই। রাজ্য স্তরে প্রয়োজনে আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে। কংগ্রেসের সঙ্গে নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও রকম গাঁটছড়ার সম্ভাবনা বন্ধ করা হলেও, ইয়েচুরি ও বঙ্গ-শিবিরের চাপে একটি দরজা খোলা রাখা হয়েছে। তা হলে ভবিষ্যতে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান হলে ফের কংগ্রেসের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা ভাবা হতে পারে। কী ঘটলে বোঝা যাবে যে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তি এসে গিয়েছে? কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের জবাব, “সেটা যখন হবে, তখনই বলা সম্ভব।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement