উৎখাত। দিল্লির ১৪ নম্বর নিউ মোতি বাগের সরকারি বাসভবন থেকে বার করে উঠোনে জড়ো করা হয়েছে তাঁর যাবতীয় আসবাব, বিছানা-বালিশ, ফাইলপত্র।
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটে বামেদের সঙ্গে জোট চেয়ে গত কাল খবরে ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফের খবরে বহরমপুরের সাংসদ তথা প্রাক্তন রেল প্রতিমন্ত্রী। তবে একেবারেই ভিন্ন কারণে।
আজ সাত সকালে দিল্লির নিউ মোতি বাগের সরকারি বাসভবন থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করতে নামে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের এস্টেট দফতর। তাদের দাবি, বাড়িটি ক্যাবিনেট মন্ত্রী বা সমমর্যাদার আমলার প্রাপ্য। অধীরকে এই বাসভবন ছেড়ে দেওয়ার নোটিস দেওয়ার পরেও তিনি এক রকম জোর করেই বাস করছিলেন সেখানে। বার বার ‘অনুরোধ’ করা সত্ত্বেও বাড়ি ছাড়েননি। সে জন্য আজ সাতসকালে প্রথমে তাঁর বাড়ির জল ও বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। পরে পুলিশের উপস্থিতিতে আসবাব, বালিশ-বিছানা-সহ গোটা সংসার উপড়ে এনে ফেলা হয় উঠোনে। তবে বেলা গড়াতে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ স্থগিতাদেশ দেওয়ায় আজকের মতো রেহাই পান অধীরবাবু।
আপাত ভাবে এটা প্রশাসনিক টানাপড়েন। কিন্তু ব্যাপারটা সেই বৃত্তেই থেমে থাকেনি। অধীরবাবুর অভিযোগ, সংসদে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তিনি সরব হন বলেই তাঁকে শায়েস্তা করতে প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে বিজেপি। অধীরবাবুর দাবি, তিনি কোনও বেআইনি বা অবৈধ কাজ করেননি। বরং তাঁকে সরকারি বাংলো দেওয়া নিয়ে সরকারের কাজের মধ্যেই বেজায় অনিয়ম রয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলে বিরোধী দলের সাংসদের সঙ্গে এ রকম আচরণ কোনও সরকার করতে পারে না।
অধীরবাবুর পাশে দাঁড়িয়ে প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানস ভুঁইয়া, ওমপ্রকাশ মিশ্ররাও বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ করেন। দলের এক নেতা বলেন, ‘‘ভুললে চলবে না, অধীরবাবুর সঙ্গে যে আচরণ মোদী সরকার করল তা কিন্তু তৃণমূলের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে করা হয়নি। অধীরবাবু চার বারের সাংসদ। তৃণমূলের অনেক প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী দুই বা তিন বারের সাংসদ। তাঁরা কিন্তু মন্ত্রী হিসেবে পাওয়া বাসভবনে বহাল তবিয়তে আছেন।’’ এক ধাপ এগিয়ে প্রদেশ কংগ্রেসের একাংশ আঙুল তুলছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দিকে। প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণা দেবনাথ যেমন অভিযোগ করেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শেই নরেন্দ্র মোদী এই ভাবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদকে অসম্মান করেছেন।’’
যে মন্ত্রকের অধীনে থাকা দফতর এই উচ্ছেদ অভিযানে নেমেছিল, ঘটনাচক্রে সেই নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী বাংলারই সাংসদ, বাবুল সুপ্রিয়। মোতি বাগে তিনি আবার অধীরবাবুর নিকটতম প্রতিবেশীও বটে। বাবুল বলেন, ‘‘এস্টেট বিভাগ পদক্ষেপ করেছে আদালতের নির্দেশে। দোহাই এতে রাজনীতির প্রসঙ্গ আনবেন না।’’ একটি সূত্রের খবর, অধীরবাবু যাতে ১৪ নম্বর নয়া মোতি বাগের বাড়িতেই থাকতে পারেন সে জন্য নিয়মের মধ্যে থেকে ব্যক্তিগত ভাবে চেষ্টাও করেছিলেন বাবুল। অধীরকে যাতে ওই বাসভবনে থাকতে দেওয়া হয়, সে জন্য রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের তরফেও চিঠি পাঠানো হয়েছিল নগরোন্নয়ন মন্ত্রকে। বাবুল আজ বলেন, ‘‘সরকারি নিয়ম-নীতির মধ্যে থেকে আমি চেষ্টা করেছিলাম। আজ দুপুরেও অধীরবাবুর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছি যে, হুমায়ুন রোডে তাঁকে যে নতুন বাসভবন দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেখানে মেরামতি বা কোনও কাজের দরকার হলে মুখ্য কারিগরি আধিকারিককে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব তা করিয়ে দেব। এর পর আর কী করতে পারি! বরং এই প্রস্তাব যে দিয়েছি, তাতেই কেউ বলতে পারেন আমি স্বজনপোষণ করছি।’’
ইউপিএ জমানায় রেল প্রতিমন্ত্রী হিসেবে এই বাংলোটি পেয়েছিলেন অধীরবাবু। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় টানাপড়েন। কেন্দ্রীয় কয়লা ও বিদ্যুৎ মন্ত্রী পীযূষ গয়ালকে বাড়িটি বরাদ্দ করার কথা এক প্রকার স্থির হয়ে গিয়েছিল। এক রবিবার দুপুরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাংলোটি দেখতেও গিয়েছিলেন পীযূষ। অধীরবাবুরা তাঁদের পত্রপাঠ বিদেয় করে দেন।
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে নোটিস পড়ছেন অধীর চৌধুরী
অধীরবাবুর বক্তব্য, মন্ত্রী হওয়ার আগে তিন বারের সাংসদ হিসেবে হরিশ মাথুর রোডে একটি সরকারি বাংলো পেয়েছিলেন। রেল প্রতিমন্ত্রী যখন হন, তখনই লোকসভার হাউস কমিটিকে বলেছিলেন, তিনি যেহেতু কম দিন মন্ত্রী থাকবেন, তাই চার বারের সাংসদ হিসেবে তিনি যে রকম বাংলো পাওয়ার যোগ্য, তেমনটাই বরাদ্দ করা হোক। সেই মোতাবেক নিউ মোতি বাগের বাংলোটি বরাদ্দ করা হয়। এখন অধীরবাবু চার বারের সাংসদ। ফলে তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিল, এ বার কেন উঠে যেতে হবে? তাঁর কথায়, ‘‘এর পরেও বাড়িটি ছাড়তে আপত্তি ছিল না। কিন্তু যেহেতু নিউ মোতি বাগ খুবই নিরাপদ এবং আমার মেয়ের স্কুলের কাছে, তাই সংসদের হাউস কমিটিকে বলেছিলাম এখানেই অনেকগুলি ছোট বাংলো ফাঁকা রয়েছে। তার মধ্যে একটি বরাদ্দ করো।’’ কিন্তু অধীরবাবুকে যে বাংলোটি দেওয়া হয়, সেখানে গিয়ে দেখেন তা ক্যাবিনেট সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রভা রাওকে আগেই বরাদ্দ করা হয়েছে। পরে এপ্রিল মাসে তাঁকে চিঠি দিয়ে বলা হয়, (বরাদ্দ নম্বর ০৮৩) তাঁকে এই বাড়িতে থাকতে হলে তিন হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। সেই ভাড়াও তিনি মিটিয়ে দেন। কিন্তু সেখানেই নিষ্পত্তি হয়নি বিষয়টির। মাসখানেক আগে থেকে ফের নোটিস পাঠাতে শুরু করে এস্টেট বিভাগ। তাঁরা হুমায়ুন রোডে একটি টাইপ-সাত বাংলো বরাদ্দ করে। কিন্তু অধীরবাবুর মতে, ওই বাড়িটি নিরাপদ নয়। এলাকাটিও সুরক্ষিত বলে মনে করেন না। তাই তিনি ফের আর্জি রাখেন, বাড়িটি মেরামত ও সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করা হোক। কিন্তু পরে গিয়ে দেখেন, শুধু চুনকাম ছাড়া কিছু করা হয়নি। এই অবস্থায় আদালতের দ্বারস্থ হন অধীরবাবু। আদালত নির্দেশ দেয়, ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হুমায়ুন রোডের বাড়িতে উঠে যেতে হবে। বাড়িটি সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা করবে সরকার। অধীরবাবুর বক্তব্য, ‘‘সরকার এখনও তা করেনি। তাই গত কাল উচ্চ আদালতে গিয়েছিলাম। উচ্চ আদালত আমার আর্জি খারিজ করে দেয়। আজ ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হই। কিন্তু ডিভিশন বেঞ্চের শুনানি ছিল দুপুর আড়াইটে নাগাদ। মামলা নম্বর ছিল ৭৩। কিন্তু শুনানির অপেক্ষা না করেই এস্টেট বিভাগ উচ্ছেদে নেমে পড়ে।’’
লোকসভার হাউস কমিটির চেয়ারম্যান তথা অর্জুন মেঘওয়ালের সঙ্গেও আজ কথা বলেন, অধীরবাবু। তাঁকে বলেন, ‘‘সরকার দেখাতে চাইল যেন, সাংসদ হয়েও আমি নিয়ম মানছি না। এটা দুর্ভাগ্যজনক। অথচ আমি মনে করি, এই বাসভবন আমার পৈতৃক সম্পত্তি নয়। শুধু চেয়েছিলাম বার বার বাড়ি বদল করিয়ে যেন হেনস্থা না করা হয় এবং পরিবারের সুরক্ষার বিষয়টি দেখা হয়।’’
মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পরেও সরকারি বাসভবন না-ছাড়া নিয়ে চাপানউতোর নতুন কোনও ঘটনা নয়। কেন্দ্রে ইউপিএ জমানায় দুই বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিংহ ও যশবন্ত সিন্হা এমনটাই করেছিলেন। মোদী জমানায় সরকারি বাসভবন ছাড়ার ব্যাপারে বহু টালবাহানা করেন অজিত সিংহ, অম্বিকা সোনির মতো নেতা-নেত্রীরা।
অধীরবাবুর বিষয়টি একটু আলাদা। চার বারের সাংসদ ও প্রাক্তন রেল মন্ত্রী হিসেবে নিউ মোতি বাগের বাসভবনটিতে তাঁকে থাকতে দেওয়া যেতে পারত বলেই মনে করছেন অনেকে। কিন্তু বাংলোর অভাবের জন্য সরকার এখন টাইপ-সাত বাংলোগুলির শ্রেণি পরিবর্তন করে টাইপ-আট করে দিয়েছে। সমস্যা হয়েছে সেখানেই। যদিও এ সব প্রশাসনিক হিসেব-নিকেশকে আমল দিতে নারাজ পশ্চিমবঙ্গের অনেক কংগ্রেসের নেতাই। তাঁরা বলছেন, এর পিছনে রাজনীতিটাই আসল।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকে বাংলো থেকে উৎখাতের চেষ্টার প্রতিবাদে এ দিন পথেও নামেন কংগ্রেসের কিছু নেতা-কর্মী। বিজেপির রাজ্য দফতরের কাছে মিনিট ২০ চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। কংগ্রেসের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা সভাপতি নীলাঞ্জন রায়ের হুঁশিয়ারি, ‘‘আমরা গণতান্ত্রিক ভাবে এর জবাব দেব। বাংলা থেকে মমতার সরকার এবং দিল্লি থেকে মোদী সরকারকে উচ্ছেদ করব।’’