বিয়ের দিনে সাদা চাদরে ‘সতীত্বের পরীক্ষা’ দিতে হল না ঐশ্বর্যকে

পুলিশি পাহারায় বিয়ে করে সোজা বাড়িতেই ফিরলেন পুণের বছর আঠাশের যুবক। সাদা চাদরে ‘সতীত্বের পরীক্ষা’  (ভার্জিনিটি রিচুয়াল) দিতে হল না নববধূ ঐশ্বর্যকেও। তবু এ ভাবেই সংসার পাতলেন মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের প্রাক্তনী।

Advertisement

স্নেহাংশু অধিকারী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৮ ০৩:২০
Share:

বিবেক-ঐশ্বর্য।

বিয়েতে বিপ্লব!

Advertisement

দিন কুড়ি আগে বিয়ের কার্ড ছাপিয়েছিলেন বিবেক তমাইচীকর। পুরোটা মরাঠিতে। ইংরেজি বাক্য একটাই— ‘স্টপ দ্য ভি রিচুয়াল’!

ব্যাপার কী? পুরোটা বোঝা গেল ১২ মে, বিয়ের দিনে। পঞ্চায়েতের বলে দেওয়া হোটেলে নয়। পুলিশি পাহারায় বিয়ে করে সোজা বাড়িতেই ফিরলেন পুণের বছর আঠাশের যুবক। সাদা চাদরে ‘সতীত্বের পরীক্ষা’ (ভার্জিনিটি রিচুয়াল) দিতে হল না নববধূ ঐশ্বর্যকেও। তবু এ ভাবেই সংসার পাতলেন মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেসের প্রাক্তনী।

Advertisement

কিন্তু ‘৪০০ বছরের প্রাচীন প্রথা’ কি রাতারাতি এ ভাবে উপড়ে ফেলা যায়! হার না মেনে পুণের পিঁপরীতে কঞ্জরভাট জনজাতিরই এক জন হয়ে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন বিবেক। দোসর, জ্ঞাতিদের বেশ কয়েক জন মিলিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের ৭৪ জন। তাঁদের প্রতিপক্ষ ওই সাদা চাদর!

জাত পঞ্চায়েতের নিদান— বৌ ‘সতী’ কি না, তা জানতে হবে প্রথম রাতেই! তাই মোড়লই হোটেলের ঘর দেবেন। বিছানার সাদা চাদরটাও। সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে সারা রাত বসে থাকবেন বন্ধ দরজার ও-পারে। তার আগে ঘরে এক মহিলাকে পাঠাবেন মোড়ল। তিনি আপাদমস্তক দেখে আসবেন পাত্রীকে— কোথাও ‘খুঁত’ নেই তো! হাতে একগাছি চুড়িও পরে থাকতে পারবেন না নববধূ। আর সকালে বর বিছানা ছেড়ে এসে দেখাবেন চাদরের ‘দাগ’। ব্যস্, বিয়ে মঞ্জুর। দশ কিংবা বিশ হাজারে ‘খুশি’ পঞ্চায়েতও। বিয়ের আগে পর্যন্ত মেয়েদের এ ভাবেই ‘অক্ষতযোনি’ করে রাখতে চাইছে কঞ্জরভাট গোষ্ঠীর পঞ্চায়েত।

আরও পড়ুন: ‘স্বর্গ’ গড়বেন বিপ্লব, পথের দাবিতে ভুল!

কী হয় চাদরে দাগ না-পড়লে? বিবেক তখন ক্লাস ফোর। বলেন, ‘‘এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়ে দেখেছিলাম, সাতসকালে নববধূকে জুতোপেটা করছে কয়েকটা লোক। আর কে যেন ভিড় থেকে বলে উঠল- ‘‘ইয়ে তো খোটা নিকলা।’ অচল তো পয়সা হয়, মানুষও! স্কুলে গিয়ে ক্লাস টিচারকে প্রশ্ন করেছিলাম। উত্তর মেলেনি। মাকে জিজ্ঞাসা করে মার খেতে হয়েছিল।’’

লড়াই: বাউন্সারদের নিয়ে এ ভাবেই বিয়ে সারলেন বিবেক-ঐশ্বর্য।

২০১৫-য় পাকা দেখার পরেই পাত্রীর দাদুকে গিয়ে ধরেছিলেন বিবেক। ভেবেছিলেন, চুটিয়ে রাজনীতি করা লোকটা নিশ্চয় বুঝবেন। প্রগতিশীল দাদু বুঝলেন সবটাই। কিন্তু নিজের বাড়িতে কে আর জেহাদে সায় দেয়! তত দিনে ব্যক্তিপরিসরের অধিকারকে মৌলিক অধিকার বলে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। ২০১৭-র অগস্ট। পঞ্চায়েতের খবরদারি রুখতে ‘সামাজিক বয়কট প্রতিরোধ আইন’-ও চালু হয়ে গিয়েছে রাজ্যে। এগুলিকে হাতিয়ার করেই বিবেক ও তাঁর তুতো বোনেরা মিলে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলেন।

কিন্তু বিয়েটা তো কোর্টেও হতে পারত! বিবেকের উত্তর, “তা হলে লড়াইটার কী হত? যে-মায়ের কোল থেকে মেয়েকে আনলাম, প্রথামাফিক ৫২৫ টাকা দিয়ে এসেছি তাঁকে। কিন্তু পঞ্চায়েতের দাদাগিরি মানব না।’’ ২১ বছর আগে কোর্টে বিয়ে করেছিলেন বিবেকের মামা কৃষ্ণ ইন্দ্রেকর। দীর্ঘদিন একঘরে করে রাখা হয়েছিল তাঁর পরিবারকে।

বিয়ের কার্ড ছাপিয়েই তাই রাজ্য মহিলা কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন বিবেক। সেখান থেকে ফোন যায় পুণের পুলিশ কমিশনারের কাছে। বিয়ের আসর ছেয়ে যায় বাউন্সার আর পুলিশে। এর আগে আত্মীয়-পড়শির বিয়েতে এই প্রথা ভাঙতে গিয়ে বেশ কয়েক বার মারও খেতে হয়েছে বিদ্রোহী ছেলেমেয়েগুলোকে। পাশে দাঁড়ায় ‘মহারাষ্ট্র অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি’।

কিন্তু রোজকার দৌড়ঝাঁপের জীবনে তো সতীচ্ছদ নানা কারণেই ছিন্ন হতে পারে। সমাজের একাংশ তা মানছে কই! সতীত্ব নিয়ে আদিখ্যেতার ছবি তাই এক নৈহাটিতেও। তাঁর ক্লিনিকে আসা এক যুবকের কথা বললেন মনঃসমাজকর্মী মোহিত রণদীপ। বছর তিরিশের ওই যুবকের জেদ, ‘নিষ্কলুষ’ বৌ চাই। অথচ তিনি নিজে একাধিক নারীসঙ্গ করেছেন। মোহিতের কথায়, “এটাই সম্ভবত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মূলগত চাহিদা। স্ত্রী আমার। সম্পত্তির এই অধিকারবোধটা কোথাও থেকে গিয়েছে।’’

নবদম্পতিও মানছেন, লড়াই বাকি। “পথ চলা সবে শুরু,” হোয়াটসঅ্যাপ করার দু’দিন পরে বললেন ঐশ্বর্য। বিয়ের পর থেকেই তাঁরা জুটিতে শহরছাড়া।

পঞ্চায়েতের ভয়ে নয়। মধুচন্দ্রিমা চলছে যে! অচেনা শহরে নিজেদের পছন্দসই হোটেলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement