—প্রতীকী চিত্র।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি সরকারকে তিরস্কার করেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে গোটা দেশে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা পরিকাঠামো নিয়ে, রোগীদের সঙ্গে ব্যবহার নিয়ে। বলাই যেত, ‘যাক...’! কিন্তু কোথায় যেন আটকাচ্ছে। শীর্ষ আদালত এ কথা বললেও, নীতি নির্ধারকদের আচরণে তো স্বস্তি মিলছে না।
এই অতিমারির ছোবলে যদি গরিব বড়লোক নির্বিশেষে আক্রান্ত না হতাম, তা হলে দেশের স্বাস্থ্য অব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেই সীমাবদ্ধ থাকত। অথবা ঘনিষ্ঠ মানুষের চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু হলে পারিবারিক গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত এই অব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ।
আর এই অর্থেই, এই মুহূর্তে, রাজনীতির দিশা যাই হোক না কেন, করোনাই কিন্তু একমাত্র তর্কের অতীত ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’— গরিব বড়লোকের মধ্যে প্রভেদ না করার কারণেই।
আরও পড়ুন: নিছকই বিচ্ছিন্ন ঘটনা, বোড়াল শ্মশানের ভিডিয়ো প্রসঙ্গে মন্তব্য রাজ্যের
অথচ এই অতিমারি আমাদের কাছ থেকে তিন মাসের আয় ছিনিয়ে নিয়েছে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে অপ্রতুল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কারণে বাজারের আর্থিক ক্ষতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। এত দিন আমরা ভাবিনি, কারণ এ রকম সর্বগ্রাসী মারণ রোগ সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমাদের দরজাতেও কড়া নাড়েনি। অথচ অপ্রতুল স্বাস্থ্যব্যবস্থা চিরকালই কিন্তু ঘুণ পোকার মত অর্থনীতির ক্ষতির কারণ হয়ে থেকেছে।
অনেকেই বলছেন লকডাউনে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি না করে আমরা আমাদের জীবন ঈশ্বরের হাতে সঁপে দিয়েই নিশ্চিন্তে আছি। অনেকেই আবার টেনেছেন অর্থমন্ত্রীর পাঁচ কিস্তির সাংবাদিক বৈঠকের কথা। যে বৈঠকে দেশের আর্থিক সংস্কারের সঙ্গে মাস্ক ও রোগ প্রতিহারী বর্মের উৎপাদন কত বেড়েছে তার তথ্য মিললেও, একবারের জন্যও উচ্চারিত হয়নি দেশে আপৎকালীন ভিত্তিতে ভেন্টিলেটরের সরবরাহ কতটা বেড়েছে সেই তথ্য।
কিন্তু এত অনুযোগ! তা অভিযোগ হয়ে ওঠে যখন সরকারি তথ্যই বলে— দেশে আয়ের নিরিখে শেষের ২৫ শতাংশের মধ্যেকার ৩৯ শতাংশই মারা যাওয়ার আগে কোনও চিকিৎসার সুযোগ পান না। বর্তমান জনসংখ্যার নিরিখে এই ২৫ শতাংশ মানে কিন্তু প্রায় ৩০ কোটি। আর তার ৩৯ শতাংশ গিয়ে দাঁড়ায় ১২ কোটির কাছাকাছি। অর্থাৎ দেশের ১০ শতাংশের মতো মানুষ, বর্তমান জনসংখ্যার হিসেবে ধরলে প্রায় ১২ কোটি মানুষ, মারা যান চিকিৎসা না পেয়েই! করোনার ছোবল না খেয়েই।
চিত্রটা আরও কালো হতে থাকে, যখন দেখি চিকিৎসার খরচ বাড়ছে খুচরো মূল্যবৃদ্ধির থেকে বেশি গতিতে। খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার যখন ৫.৮৪ শতাংশ, তখন চিকিৎসার খরচ বাড়ছে ৭ শতাংশেরও বেশি হারে। একদিকে রোজগার কমছে। আর একদিকে বাড়ছে সুস্থ থাকার খরচ। আর অসুস্থতা কাড়ছে আমাদের রোজগার। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে পেশ করা গ্লোবাল হেল্থকেয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০৩০-এর মধ্যে অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে সাধারণ নানান রোগভোগের ফলে ভারতের ক্ষতি হবে প্রায় ৩২১ লক্ষ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ এক বছরের জাতীয় উৎপাদন খাবে অপ্রতুল চিকিৎসা ঘুণে। কিন্তু তা এড়াবার কোনও পদক্ষেপ সে ভাবে দেখলাম কই। আয়ুষ্মান ভারত খাতায় কলমে ভাল প্রকল্প। কিন্তু দেশে চিকিৎসার পরিকাঠামোই যদি না থাকে, তা হলে স্বাস্থ্য বিমা থেকে হবেটা কী? করোনার ছোবলে নাগরিক এখন হাড়ে-মজ্জায় বুঝছেন এর অর্থ, কাছের মানুষের মৃত্যুর মূল্যে।
কেরল কোভিড যুদ্ধে জয়ী, কিন্তু বাকিরা? আর তার কারণই তো প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার অপ্রতুলতা। কেরল পেরেছে। দক্ষিণ ভারত পারছে। কিন্তু উত্তর, পূর্ব আর পশ্চিমের রাজ্য তো শুধুই ঘাম মুছছে অপ্রতুল পরিষেবার কারণেই। ভারতে প্রতি ৫১,০০০ নাগরিকের জন্য একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এটা গড় হিসাব। গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অরবিন্দ কস্তুরীর হিসাব বলছে— দেশে মাত্র ৩৭ শতাংশ মানুষ তাঁদের বাড়ির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন। অর্থাৎ ৬৩ শতাংশ মানুষ বাড়ির পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাসপাতাল পান না। চিকিৎসা না পেয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে মারা যান তার সব কারণের মধ্যে এটাও কিন্তু একটা। কিন্তু একমাত্র নয়।
আমরা সমৃদ্ধ দেশে বাঁচতে চাই। কারণ একটাই। নিজেদের সমৃদ্ধির কারণেই। দেশের ভাল হলে দশের ভাল। আমরা সবাই খেয়ে-পড়ে সুস্থ হয়ে বাঁচব। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গরিব বড়লোকের ভেদ থাকবে না। সবাই বাঁচার সমান সুযোগ পাবে। কিন্তু এ অঙ্ক আমরা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছি। অক্সফামের দারিদ্র নিয়ে করা নিয়মিত সমীক্ষা বহু আলোচিত। তবুও একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ভারতের আয়ের নিরিখে যাঁরা প্রথম ১০ শতাংশে, তাঁরা দেশের ৭৭ শতাংশ সম্পদের অধিকারী। ২০১৭ সালে দেশে যে সম্পদ সৃষ্টি হয়েছিল, তার ৭৩ শতাংশ গিয়েছে এক শতাংশের ঘরে আর দেশের ৬ কোটি ৭০ লক্ষ হতদরিদ্রের সম্পদ বেড়েছে ১ শতাংশ। অর্থাৎ আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে।
এর ফল? সরকারি তথ্যই বলছে— ভারতে ১৪.৪ শতাংশ পরিবারে চিকিৎসা করাতে গিয়ে একজন সদস্যের গোটা বছরের খরচ চলে যায়! এবং ১২ কোটির অসহায় মৃত্যুর এটা অন্যতম কারণ। এর পরেও আমরা ভাবব দেশের সমৃদ্ধি দশের সমৃদ্ধি? বলেছিলাম কেন্দ্র সাধারণের স্বাস্থ্যবিমা চালু করেই দায়বদ্ধতা কমাচ্ছে। স্বাস্থ্যরক্ষার দায় রাজ্যের ঘাড়ে চাপিয়েই। হ্যাঁ। এটা অনস্বীকার্য যে কেরল-সহ দক্ষিণ ভারত স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উত্তরের থেকে অনেক উন্নত করে তুলেছে। এটা কেন হয়েছে তার আলোচনা অন্য জায়গা দাবি করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ২০১৯ সালের স্বাস্থ্য সমীক্ষাই বলছে— ভারতে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জাতীয় উৎপাদনের ১ শতাংশের একটু উপরে যখন বাংলাদেশ ও নেপাল ছাড়া অন্য প্রতিটি কাছের দেশগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে খরচের অংশ আমাদের থেকে অনেক বেশি। তাই শুধু রাজ্যকেই বা দোষ দিই কী করে?
আরও পড়ুন: মহুয়াকে খোঁচা দিয়ে তৃণমূলের নিশানায় ‘ললিপপ’ ধনখড়
অতিমারিতে আমরা চেয়েছিলাম চিকিৎসার সুযোগ। কিন্তু তা তো জুটছে না। শীর্ষ আদালতের ক্ষোভেই পরিষ্কার যে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কী অবস্থা। হ্যাঁ। এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে এই অতিমারি একটা চ্যালেঞ্জ। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা কি সাধারণের জীবন নিয়ে সত্যি চিন্তিত? এই অতিমারির সময়েই যে ভাবে ভোট যুদ্ধের দামামা বেজেছে তাতে তো মনে হচ্ছে না। আর পরিসংখ্যানের ইঙ্গিতও যে তাই!