রোজই লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ।—ছবি এএফপি।
আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ভারতে করোনা-সংক্রমিতের সংখ্যা ১০ লক্ষ পেরিয়ে গিয়েছিল গত কাল রাতেই। আজ সরকারি ভাবে নরেন্দ্র মোদী সরকারও পরিসংখ্যান দিয়ে একই কথা জানিয়ে দিল। আর এ দিনই কেরল সরকার দাবি করল, ওই রাজ্যের বেশ কিছু এলাকায় গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও সেই দাবি মানতে চায়নি কেন্দ্র।
রোজই লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। এমনকি এখন মাত্র তিন দিনে এক লক্ষ রোগী বাড়ছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসেবে, গত ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমিত হয়েছেন ৩৪,৯৫৬ জন ও মারা গিয়েছেন ৬৮৭ জন। দু’টিই রেকর্ড। সরকারি হিসেবে দেশে মৃতের সংখ্যা আজ ২৫ হাজার পেরিয়েছে। বড় রাজ্যগুলির মধ্যে তামিলনাড়ু বাদে অন্য সব ক’টিতে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। এরই মধ্যে কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন আজ জানিয়েছেন, রাজ্যের পুনথুরা, পুল্লুভিলা, তিরুঅনন্তপুরম এলাকায় গোষ্ঠী-সংক্রমণের খবর পাওয়া গিয়েছে। তাই উপকূল এলাকাগুলিতে আগামী কয়েক দিন সম্পূর্ণ লকডাউন করা হবে। যদিও এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের দাবি, কিছু এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। কিন্তু গোষ্ঠী-সংক্রমণ শুরু হয়নি। তা শুরু হলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিধিতে পরিবর্তন আনা হবে।
আজ মধ্যরাত পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ লক্ষ ৩৯ হাজারের বেশি। অর্থাৎ, ঊর্ধ্বমুখীই রয়েছে লেখচিত্র। এ দেশে সংক্রমণ কবে শীর্ষে পৌঁছবে, জোর গলায় বলতে পারছেন না কেউই। বিভিন্ন গাণিতিক মডেলে ‘সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’-র চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেই সূত্রেই বারবার প্রশ্ন উঠছে— সংক্রমণের লাগামছাড়া বৃদ্ধিতে রাশ টানতে সরকার কী পদক্ষেপ করছে?
আরও পড়ুন: রাজ্যে এক দিনে সংক্রমিত ১ হাজার ৮৯৪, বাড়ল সংক্রমণের হার
কিন্তু কেন্দ্রের কাছেও এর কোনও চটজলদি সমাধান নেই। ‘ভারত বায়োটেক’ আজ জানিয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে তাদের ‘কোভ্যাক্সিন’ টিকার প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়ে গিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তাদের মতে, ভারতের মতো দেশে কোভিডকে আটকাতে হলে দ্রুত প্রতিষেধক চাই। সেই কারণেই তড়িঘড়ি টিকা আবিষ্কারে জোর দেওয়া হয়েছে। তা না-হলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। একমাত্র পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখলেই করোনাকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু ১৩৫ কোটির দেশে তা করা যে বিলক্ষণ কঠিন, বুঝছে কেন্দ্র।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর আশঙ্কা, এই হারে চলতে থাকলে অগস্টেই দেশে সংক্রমণ কুড়ি লক্ষ ছাপিয়ে যাবে। পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে দ্রুত সরকারকে কড়া পদক্ষেপ করতে হবে বলে অনেকে মনে করছেন। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ফের দরকার লকডাউন— অন্তত সপ্তাহের মাঝখানে ও শেষে এক দিন করে। তাতে সংক্রমণের শৃঙ্খল অনেকটাই ভাঙবে বলে গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে দেখিয়েছেন আইআইএসসি বেঙ্গালুরুর দুই গবেষক। বহু দেশে লকডাউনের পরে সংক্রমণ কমেছে। ভারতে ঠিক উল্টো ছবি। তা সত্ত্বেও অর্থনীতির বিপর্যস্ত অবস্থার কথা ভেবে কেন্দ্রও ফের লকডাউনে রাজি নয়। তবে স্বাস্থ্যকর্তা রাজেশ ভূষণের কথায়, রাজ্য চাইলে লকডাউন ঘোষণা করতেই পারে।
আরও পড়ুন: লেনদেনের টেপে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী? রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রাজস্থান পুলিশের
প্রশ্ন উঠেছে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়েও। সাধারণ ও অক্সিজেন-যুক্ত শয্যার অভাব, আইসিইউ-তে উপচে পড়া ভিড়ের সঙ্গেই বেশ কিছু রাজ্যে কোভিড রোগীদের বিনা-চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রের যুক্তি, রাজ্যগুলি যাতে যথেষ্ট স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারে, সেই জন্যই গোড়াতে লকডাউন করা হয়েছিল। কেন্দ্র অর্থ বরাদ্দ করেছিল রাজ্যগুলির জন্য। কিন্তু ‘কিছু রাজ্য’ গা-ছাড়া মনোভাব দেখিয়েছে। এখন তারা সমস্যায় পড়েছে।
পর্যাপ্ত সংখ্যক পরীক্ষা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন গোড়া থেকেই উঠেছে। চিন থেকে আসা ত্রুটিপূর্ণ কিটের ফলে দেশে করোনা পরীক্ষার গতি শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছিল। যদিও আইসিএমআরের ডিজি বলরাম ভার্গব জানিয়েছেন, দেশে এখন রোজ তিন লক্ষেরও বেশি আরটি-পিসিআর পরীক্ষা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতি দশ লক্ষে অন্তত ১৪০টি পরীক্ষা করানোর কথা বলেছে। ভারতে গড়ে হচ্ছে ২০১টি পরীক্ষা। সংক্রমণের প্রকৃত চিত্রটি পেতে গত কাল ভার্গব প্রতিটি রাজ্যকে অ্যান্টিজেন টেস্ট বাড়াতে বলেছেন। কেন্দ্রের যুক্তি, পরীক্ষা বাড়ানো নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রশাসনিক দক্ষতার উপরে। যেমন গোয়াতে রোজ প্রতি দশ লক্ষে ১৫০০-র কাছাকাছি পরীক্ষা হচ্ছে। সেখানে বিহার করছে ১৫০ পরীক্ষা। তার ফলে বিহারের পরিস্থতির ক্রমশ অবনতি হয়েছে। সেখানকার চিকিৎসকদের সাহায্য করতে আজ কেন্দ্রীয় দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এমন দল তো অতীতে পশ্চিমবঙ্গেও এসেছে। কিন্তু তখন সমন্বয়ের পরিবর্তে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত বেধেছে। কেন্দ্রের যুক্তি, স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখার এক্তিয়ার রাজ্যের। কেন্দ্র পরামর্শ দিতেই পারে। কিন্তু রাজ্যকেই তা কার্যকর করতে হবে, স্বাস্থ্য থেকে আইন-শৃঙ্খলা— যাবতীয় ক্ষেত্রকে সমন্বয়ে বেঁধে। কেন্দ্রের মতে, নিজেদের স্বার্থেই ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে জনতাকেও।