corona virus

‘বিমানে যেন শুধু যাত্রীরাই ওঠেন, প্যাথোজেন নয়!’

একই ভাবে ২০০৯ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিও ছড়িয়েছিল বিশ্বের বহু দেশে। আর এত দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পিছনে বিশ্বের আন্তর্জাতিক এবং অন্তর্দেশীয় বিমানবন্দরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এমনটাই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানী-গবেষকদের একটি অংশ।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০২০ ০২:৩৬
Share:

বিমানযাত্রীদের মাধ্যমে একটি নতুন প্যাথোজেনের অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে—নিজস্ব চিত্র

মধ্য এশিয়া থেকে বিমানে বাড়ি ফেরা দক্ষিণ কোরিয়ার এক জন মাত্র নাগরিকের মাধ্যমে মার্স (মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) ছড়িয়ে পড়েছিল সংশ্লিষ্ট দেশে। যার ফলে প্রাণহানির পাশাপাশি মাত্র দু’মাসেই আর্থিক ক্ষতির আনুমানিক পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৮০০ কোটি ডলার! তারও বেশ কয়েক বছর আগে ২০০২-’০৩ সালে সার্স (সিভিয়র অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) হংকং থেকে আরও ২৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। একই ভাবে ২০০৯ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিও ছড়িয়েছিল বিশ্বের বহু দেশে। আর এত দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পিছনে বিশ্বের আন্তর্জাতিক এবং অন্তর্দেশীয় বিমানবন্দরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এমনটাই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানী-গবেষকদের একটি অংশ।

Advertisement

তাঁরা জানাচ্ছেন, বিমানযাত্রীদের মাধ্যমে একটি নতুন প্যাথোজেনের অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে। সার্স কোভ-২-এর ক্ষেত্রে তেমনই হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) এক গবেষকের কথায়, ‘‘আগে একটি মহামারি বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছতে অনেক বছর সময় নিত। ফলে তখন মহামারিতে বেশি সংখ্যক মানুষ মারা গেলেও তা মূলত নির্দিষ্ট পরিধিতে সীমাবদ্ধ থাকত।

বর্তমানে বিমানযাত্রার মাধ্যমে খুব দ্রুত একটি সংক্রামক রোগের জীবাণু অন্য দেশে পৌঁছে যেতে পারে। তা-ও আবার যাত্রীর শরীরে রোগের কোনও লক্ষণ ফুটে ওঠার আগেই।’’ একই সঙ্গে বিজ্ঞানী-গবেষকেরা এও জানাচ্ছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ মেনে চললে নিয়ন্ত্রিত ভাবে বিমান চলাচল অবশ্যই সম্ভব।

Advertisement

বিমান-যাত্রায় যে যে নিয়ম মানা দরকার

• যেখান থেকে বিমানযাত্রীরা উঠছেন, সেখানে তাঁদের এক
বার স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করতে হবে
• বিমান গন্তব্যে নামার পরে আর এক বার পরীক্ষা
• শুধু যাত্রীরা নন, বিমানকর্মী-সহ সকলেরই স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করা প্রয়োজন
• প্রয়োজনে কোয়রান্টিন কেন্দ্রে
বা হোম আইসোলেশনে কমপক্ষে ১৪ দিন থাকা উচিত
• গ্লাভস, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক, মাথাও ঢাকা দরকার
• বিমানবন্দরে ও বিমানের মধ্যে দূরত্ব-বিধি মেনে চলতে হবে
• হাত পরিষ্কার রাখায় বাড়তি গুরুত্ব, স্যানিটাইজ়ার ব্যবহার করা দরকার
• শুধু ভ্রমণের ইতিবৃত্তই নয়, যাত্রী বা কর্মীরা কোথায় থাকেন, সেখানে কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়েছে কি না, সে সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন

দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংক্রমণের হার আলাদা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে হু-র পরামর্শদাতা তথা ‘দ্য সেন্টার ফর ডিজ়িজ় ডাইনামিক্স, ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিসি’-র (সিডিডিইপি) ডিরেক্টর রামানন লক্ষ্মীনারায়ণ বলছেন, ‘‘লক্ষ করলে দেখা যাবে, দেশের যে সমস্ত জায়গায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে, সেখানেই সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বেশি। ওই সব অঞ্চলেই এপিডেমিক-কার্ভ ঊর্ধ্বমুখী।’’

‘এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া’-র তথ্য বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় আন্তর্জাতিক বিমানযাত্রীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৯ হাজার ৩৯৮ এবং অন্তর্দেশীয় বিমানযাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৬ লক্ষ ১৩ হাজার ৫৩৩। অর্থাৎ, মার্চে লকডাউনের আগের মাসে কলকাতা বিমানবন্দরে মোট বিমানযাত্রীর (আন্তর্জাতিক ও অন্তর্দেশীয়) সংখ্যা ছিল ১৮ লক্ষ ৩২ হাজার ৯৩১। মুম্বই (মহারাষ্ট্র) এবং দিল্লিতে সেই যাত্রী সংখ্যা (আন্তর্জাতিক ও অন্তর্দেশীয়) যথাক্রমে ছিল ৩৯ লক্ষ ৮১ হাজার ৮২৪ এবং ৫৯ লক্ষ ৯৩ হাজার ১৫৭। আমদাবাদে (গুজরাত) সেই সংখ্যা ১০ লক্ষ ১৩ হাজার ২৪৮ জন এবং চেন্নাইয়ে (তামিলনাড়ু) ছিল ১৮ লক্ষ ৭০ হাজার ৪০৯ জন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমিত রোগীর সংখ্যার নিরিখে এই রাজ্যগুলির অবস্থানও দেশের মধ্যে একদম প্রথম সারিতেই।

‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এর এপিডিমিয়োলজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান শম্পা মিত্রের মতে, যাঁরাই বিমানবন্দরে ঢুকবেন, তাঁদের প্রত্যেকের থার্মাল স্ক্রিনিং করা প্রয়োজন। প্রত্যেকের হাত ধুয়ে গ্লাভস ও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
তাঁর কথায়, ‘‘রোগের সামান্যতম লক্ষণও নজরে এলে সংশ্লিষ্ট যাত্রীকে কোনও ভাবেই বিমানে ওঠানো যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বাড়ি বা কোয়রান্টিন কেন্দ্রে পাঠানো দরকার।’’ ‘এয়ারলাইন্স অপারেটর্স কমিটি’র (কলকাতা) প্রাক্তন চেয়ারম্যান সর্বেশ গুপ্তের কথায়, ‘‘দিনের পর দিন বিমানবন্দর বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। আর্থিক ক্ষতি তো বটেই। তা ছাড়া পরিবার-পরিজন যাঁরা বাইরে রয়েছেন, তাঁদেরও ফিরিয়ে আনার জন্য বিমান পরিষেবা শুরু করা প্রয়োজন।’’ তিনি মনে করছেন, সতর্কতার সমস্ত নিয়ম পালন করলে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সকলকে মনে রাখতে হবে যে, সতর্ক থাকা এবং আতঙ্কিত হওয়া এক জিনিস নয়। নিজেকে এবং অন্যকে সুস্থ রাখতে মানসিক অবস্থানে পরিবর্তন আনতে হবে বলে জানাচ্ছেন তিনি। ‘ওয়ার্ল্ড সোসাইটি ফর ভাইরোলজি’-র প্রেসিডেন্ট তথা ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’-র এমেরিটাস বিজ্ঞানী অনুপম বর্মার কথায়, ‘‘বাস, ট্রেন চালানোর ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ করলে, নিয়ন্ত্রিত ভাবে বিমান চলাচলও সম্ভব। বিমানে যেন শুধু যাত্রীরাই ওঠেন, প্যাথোজেন নয়!’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement