নজরদারি নিয়ে তরজা নানা রকম চলছিলই। বোমাটি ফেটেছে কাল। আর তাতেই তোলপাড় দেশ। সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবারের উপরে দু’দশক ধরে নজরদারি চালিয়েছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু— এই তথ্য সামনে আসতেই তুঙ্গে উঠেছে বিতর্ক ও চাপানউতোর। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বসু পরিবারের সদস্যদের দাবি, বিদেশ মন্ত্রকে ২৯টি ও প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ৫৮টি গোপন ফাইল রয়েছে নেতাজিকে নিয়ে— সেগুলির সব ক’টি প্রকাশ্যে আনা হোক। বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিও তুলেছেন ক্ষুব্ধ বসু পরিবারের লোকজন। নেহরু জমানার নজরদারি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া দরকার, বলছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুও। কংগ্রেস কিন্তু বলছে, গোটাটাই বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের ষড়যন্ত্র।
কেন এই অভিযোগ?
সংসদে শক্তির নিরিখে কংগ্রেস এখন আর পাঁচটা আঞ্চলিক দলের বেশি কিছু নয়। পরের পর বিধানসভা ভোটেও ডাহা হেরে চলেছে কংগ্রেস। ব্যক্তিগত ভাবে রাহুল গাঁধীর ব্যর্থতার প্রসঙ্গ তো উঠছেই, জাতীয় রাজনীতিতে এই প্রশ্নও উঠেছে যে, তবে কি গাঁধী পরিবারের মহিমাই সঙ্কটে! কংগ্রেসের অনেক নেতাই মনে করেন, দলটাকে একজোট করে রাখাই হোক বা চাঙ্গা করে তোলা, গাঁধী পরিবারের বিকল্প নেই দলে। সার্বিক এই প্রেক্ষাপটেই ইদানীং অতি-সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন সনিয়া গাঁধী। তলানি থেকে দলটাকে ফের আগের অবস্থায় টেনে তোলার মরিয়া চেষ্টা শুরু করেছেন। নরেন্দ্র মোদীর জমি নীতির বিরোধিতা করে পথে নেমেছেন। সেই সঙ্গে ১৯ এপ্রিল জমি অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে কৃষক সভার ডাক দিয়েছেন। কার্যত ওই সভার মাধ্যমে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে গাঁধী পরিবারকে ফের পুরনো মহিমায় মেলে ধরার মরিয়া চেষ্টায় নেমেছেন সনিয়া। সেই চেষ্টায় জল ঢালতেই নরেন্দ্র মোদীরা গাঁধী পরিবারের ভাবমূর্তির উপরেই সরাসরি আঘাত হানতে চাইছেন বলে অভিযোগ কংগ্রেসের নেতাদের। তাঁদের দাবি, কংগ্রেসকে রাজনৈতিক ভাবে আরও দুর্বল করে দিতেই গাঁধী পরিবার সম্পর্কে বিদ্বেষের বীজ বুনছে মোদী-জেটলি-সঙ্ঘ পরিবার।
কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক শীর্ষ সারির নেতা আজ বলেন, ‘‘আসলে জমি নীতির বিরোধিতা উপলক্ষ মাত্র। সনিয়ার কাছে উনিশের সভার গুরুত্ব অন্য। আসল কথা হল, সবর্ভারতীয় রাজনীতিতে গাঁধী পরিবারের মাহাত্ম্য ধরে রাখার লক্ষ্যেই ওই সভার ডাক দিয়েছেন সনিয়া। কারণ, তিনিও বুঝতে পারছেন, ওই মহিমা টিকে থাকলে তবেই কংগ্রেস টিকে থাকবে। রাহুল গাঁধীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও সুনিশ্চিত হবে। নইলে কংগ্রেসটাই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।’’ তাৎপর্যপূর্ণ হল, এক দশক পর কংগ্রেসের কোনও জনসভার মঞ্চে ফিরে আসছে শুধুই গাঁধী পরিবারের মুখ। সনিয়া ও রাহুল!
কিন্তু মা-ছেলের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এই প্রয়াসের ঠিক আগে নেহরু-গাঁধী পরিবার সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই বিচলিত কংগ্রেস। মূলত দু’টি প্রশ্ন তুলছে তারা। এক, কেন ঠিক এই সময়েই এ সব ঘটছে? বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, মোদীর জার্মানি সফরের সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন নেতাজির পৌত্র। তিনি নেতাজি সম্পর্কিত সব ফাইল প্রকাশের দাবি জানাবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তার ঠিক আগেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে মহাফেজখানায় পাঠানো দু’টি ফাইলের বিষয় সামনে আনা হল। এগুলিকে মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছে না কংগ্রেস।
কংগ্রেসের দ্বিতীয় প্রশ্ন বল্লভভাই পটেলকে জড়িয়ে। নেহরু জমানার প্রথম তিনটি বছর, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কংগ্রেসের প্রশ্ন, পটেলের সুবিশাল মূর্তি তৈরি করাচ্ছেন মোদী, অমিত শাহরা! নেহরু জমানায় আইবি-র নজরদারি কি পটেলের অগোচরে হয়েছে? দিগ্বিজয় সিংহের কথায়, ‘‘বিজেপি পটেলের দিকেও আঙুল তুলছে কিনা তা স্পষ্ট করা উচিত মোদীর।’’ এর সঙ্গে সরাসরি মোদীর দিকেও পাল্টা আক্রমণ শানান দিগ্বিজয়। তাঁর কথায়, ‘‘মোদীর এটাও স্পষ্ট করে জানানো উচিত, তিনি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অমিত শাহকে দিয়ে কার কার উপরে নজর রাখতেন? একটি নিরীহ মেয়ের উপরেই বা কেন নজর রেখেছিলেন অমিত শাহ?’’
নেতাজি-নেহরু বন্ধুত্বের কথা তুলে ধরেও নজরদারির বিষয়টিকে লঘু করার চেষ্টা করেন কংগ্রেসের ওই প্রবীণ নেতা। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘নেতাজির সঙ্গে নেহরুর মতের ফারাক থাকলেও দু’জনের নিবিড় বন্ধুত্বের কথা ইতিহাসবিদরা জানেন। এমনকী, নেহরু এ-ও মনে করতেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নেতাজি থাকলে দেশে চরম ডানপন্থী শক্তির মোকাবিলা করা সহজ হতো।’’
নজরদারি নিয়ে এনসিপি নেতা শরদ পওয়ারের প্রতিক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন। তাঁর বক্তব্য, নজর রাখে সব সরকারই। তিনি মহারাষ্ট্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময়েও এমন নজরদারির মধ্যে ছিলেন। এতে কোনও নতুনত্ব নেই। নজর রাখা মানেই চরবৃত্তি নয়। তবে এত দিন পরে এখন কেন এই সব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, সেই প্রশ্ন তোলেন পওয়ার।
বিজেপি কিন্তু নেতাজি পরিবারের উপরে নজরদারির প্রসঙ্গ তুলে কংগ্রেসকে রাজনৈতিক ভাবে আক্রমণ শানিয়েছে এ দিনও। বেঙ্কাইয়া নায়ডুদের মতে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সম্পর্কে কংগ্রেসের মনোভাব ও আচরণ কতটা নেতিবাচক তা এই ঘটনাতেই প্রমাণিত। বেঙ্কাইয়া বলেন, নজরদারির বিষয়টি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে কথা বলব।’’
বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক ও এসইউসি-র মতো বামপন্থী সংগঠনগুলিও। এই বাম দলগুলি নেতাজি সংক্রান্ত সব ফাইল প্রকাশের দাবি জানিয়েছে ফের। পরশু জার্মানিতে মোদীর সঙ্গে দেখা করে একই দাবি জানাতে চান নেতাজির পরিবারের দুই উত্তরসূরিও। তাঁদেরই এক জন, সূর্য বসু আজ বলেন, ‘‘সুভাষচন্দ্র বসু শুধু একটি পরিবারের নয়। তিনি নিজেই বলেছিলেন, গোটা দেশ আমার পরিবার। (ফাইল প্রকাশ করার) বিযয়টি নিয়ে গোটা দেশেরই সরব হওয়া উচত। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলার সুযোগ পেলে অবশ্যই বিষয়টি তুলব।’’ নেতাজির ভাইয়ের পৌত্র সূর্য বসু হামবুর্গে ইন্দো-জার্মান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। বার্লিনে মোদীর সংবর্ধনা সভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারতীয় দূতাবাস। সূর্যবাবুরই এক ভাই এ দিন বলেন, ‘‘নেতাজি সংক্রান্ত সব ফাইল প্রকাশ করার সময় এসেছে। ওই সব ফাইল প্রকাশ্যে আনলে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হবে— এটা একটা অজুহাত। মোদীর সরকার এত দিন স্বচ্ছতার কথা বলে এসেছে। ওই সব ফাইল প্রকাশ করে এ বার সেই স্বচ্ছতার প্রমাণ দেওয়ার সময় এসেছে।’’ মনমোহনের আমলে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্টের যুক্তিতে ফাইল প্রকাশ করা হয়নি। মোদী জমানাতেও এ পর্যন্ত সেই একই কথা বলা হচ্ছে। এ নিয়ে খেদ প্রকাশ করেন নেতাজির ওই উত্তরসূরি।