রুমি নাথ
ফের বিতর্কের কেন্দ্রে বরাকের কংগ্রেস বিধায়ক রুমি নাথ। এবার বিতকের্র মূলে তাঁর সঙ্গে দেশের একনম্বর গাড়ি চুরি চক্রের পান্ডা অনিল চৌহানের সম্পর্ক নিয়ে দানা বেঁধেছে বিতর্ক। গত কালই অসম পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গাড়ি চুরি চক্রের এই পান্ডা। যখন পুলিশ তাকে ধরে তখন অনিল যে গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিলেন সেই গাড়ির মালিক রুমি নাথের বাবা। গাড়িতে বিধানসভা-সচিবালয়ের ‘কার পার্কিং স্টিকার’-ও লাগানো ছিল। এই স্টিকার রুমির সুপারিশেই যে বিধানসভা থেকে দেওয়া হয়েছিল সে ব্যাপারে পুলিশ আজ নিশ্চিত হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ জানিয়েছে, তদন্তের স্বার্থেই কংগ্রেসের ওই বিধায়ককে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
গত কাল রুমি বলেছিলেন, ‘‘গত বছর শিলচর থেকে গাড়িটি চুরি যায়।’’ রুমি বলেছিলেন, তিনি অনেককেই গাড়ির পাস দেন। তেমনই কোনও পাস অনিলের কাছে গিয়ে থাকবে। কিন্তু আজ অনিলের বাড়ি তল্লাশি করে অনিল, তার স্ত্রী রীতা ও রুমির যে সহাস্য ও ঘনিষ্ঠ ছবি দেওয়ালে ঝুলতে দেখা গিয়েছে সেই ছবি অন্য কথা বলছে। পাশাপাশি জানা গিয়েছে, ২০১৩, ২০১৪, এমনকী এ বছরেও রুমির দেওয়া পাস গাড়িতে ব্যবহার করে বিধানসভা ও সচিবালয়ে অনিলের ছিল আবাধ যাতায়াত।
পুলিশের এক কর্তার কথায়, গাড়ি মাফিয়া অনিল চৌহান যেন ফিল্মের ডন! সারা দেশের পুলিশ তাকে খুঁজছে। কিন্তু তাকে ধরা কেবল মুশকিলই নয়, কার্যত অসম্ভব। না হলে নাগাল্যান্ড, মণিপুর এমনকী অসমের কোনও প্রত্যন্ত জেলায় নয়, খোদ গুয়াহাটিতে, তাও আবার সচিবালয়ের অদূরে বসে এক দশক ধরে সারা দেশ জুড়ে গাড়ি চুরির এক বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারে কেউ? দিল্লি, মুম্বই পুলিশ তার নামে ‘লুক আউট’ নোটিশ জারি করেছে। সাড়ে তিন হাজারের উপরে গাড়ি চুরিতে জড়িত এই ব্যক্তিকে ধরতে হন্যে দেশের পুলিশ। সেই ব্যক্তিই কী না বিধায়কের গাড়ি চালিয়ে, বিধায়কের গাড়ির পাস ব্যবহার করে বিধানসভা চত্বরে নিয়মিত হাজির হতেন!
চৌহানকে ধরার পরে তদন্তকারীদের চোখ সত্যি কপালে। দিসপুরের অদূরে দ্বারকা নগরে গাড়ি চোরের ‘প্রাসাদ’ দেখে পুলিশ কর্তাদেরও তাক লেগে গিয়েছে। মার্বেলে মোড়া সেই বাড়িতে বিলাসের সব সামগ্রী মজুত। বাড়ির সামনে একটি গাড়ি, তাতে কংগ্রেস বিধায়ক রুমি নাথের পাস লাগানো। এই গাড়িটিরও প্রাক্তন মালকিন ছিলেন রুমি। যে গাড়িতে চেপে গুয়াহাটি আসার পথে সঙ্গী-সহ গ্রেফতার হয় অনিল, তার মালিক রুমি নাথের বাবা। ২০১০ সালে শিলচরে শেষবার ‘সস্ত্রীক’ অনিল ধরা পড়েছিল। পরে অবশ্য জানা যায়, ওই মহিলা তার স্ত্রী নয়। এমন অনেক মেয়েকেই স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ‘অভিযান’ চালাত অনিল।
কী ভাবে এত বড় গাড়ি চোর, বিধায়কের দেওয়া গাড়ির পাস নিয়ে নিয়মিত বিধানসভায় ঢুকত এবং তার আসার উদ্দেশ্য কী ছিল--তা নিয়ে আজ বিধানসভার প্রধান সচিবকে তদন্তের নির্দেশ দেন স্পিকার প্রণব গগৈ। বিধানসভার প্রধান সচিব গৌরাঙ্গ দাস বলেন, “আমরা যে গাড়ির পাসগুলি ইস্যু করি তা বিধায়কদের অনুরোধ মেনেই করা হয়। প্রাথমিক ভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছি ‘এএস০১এমএ ৫৯১৭’ নম্বরের গাড়িটি ২০১৩ সালে রুমি নাথের নামে বরাদ্দ ছিল। ১৮ মে, ২০১৩ তারিখে প্রথম যে পাস দেওয়া হয় সেখানে গাড়ির মালিক হিসাবে রুমি নাথ ও চালক হিসাবে অনিল চৌহানের নাম ছিল। পরে ২০১৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর
একই গাড়ির জন্য রুমির অনুরোধে পাস দেওয়া হয়। সেখানে মালিকের নাম ছিল অনিল চৌহান, চালক মিলন রাভা। এ বছর ২৯ জানুয়ারি যে পাস দেওয়া হয় সেখানে গাড়ির নম্বরে সামান্য অদলবদল করে ৫১৯৭ করা হয়েছিল। এবারেও মালিক অনিল চৌহান। চালক মিলন রাভা।” তিনি জানান, স্পিকারের নির্দেশে আজই তিনি রুমিকে এই বিষয়ে ৮ এপ্রিলের মধ্যে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠিয়েছেন।
কিন্তু, বিধানসভা চলার সময় কেন বিধায়ক, আমলা, পুলিশ বা মন্ত্রীদের গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়িকে সভা চত্বরে ঢোকার পাস দেওয়া হল? গৌরাঙ্গবাবু বলেছেন, “খোদ বিধায়ক যখন নিজে দায়িত্ব নিয়ে কাউকে পাস দিচ্ছেন সেক্ষেত্রে আমরা তা নিয়ে প্রশ্ন করি না। এই দায় বিধায়কের। বিধানসভা চত্বরে এত গাড়ি ঢোকে, যে বৈধ পাস থাকা সব গাড়ির মালিক ও চালককে পরীক্ষা করা অসম্ভব।”
আজ কী বলছেন রুমি? গত কাল এক রকম বললেও আজ রুমি মেনে নেন, তিনি কেবল অনিলের স্ত্রী রীতা চৌহানকে চিনতেনই না, রীতার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠও ছিলেন। তিনি বলেন, “রীতা কংগ্রেস কর্মী। সেই সূত্রেই ওর সঙ্গে আলাপ। আমার ঘরেও অনেকবার এসেছে। গুয়াহাটিতে আমরা একই সঙ্গে মলে ঘুরেছি, বিউটি পার্লারে গিয়েছি। রীতার অনুরোধেই তার স্বামীর নামে গাড়ির পাস বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি সত্যিই জানতাম না রীতার স্বামী কী করে।”
রুমির সাফাই উড়িয়ে বিরোধীরা উচ্চপর্যায়ে তদন্ত দাবি করেছে। তাঁদের একাংশের সন্দেহ, রুমির বাবার গাড়ি ও ট্যাঙ্কারের ব্যবসার সঙ্গে অনিলের যোগাযোগ রয়েছে। এআইইউডিএফ বিধায়ক আবদুর রহিম খান বলেন, “অনিল সামান্য অপরাধী নয়। গোটা দেশে তার জাল ছড়ানো। এমন লোককে কিছু না জেনে পাস দেওয়া বা ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর যুক্তি মেনে নেওয়া যায় না। এর পিছনে বৃহত্তর চক্র থাকতে পারে। ঘটনার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হোক।” অসম গণ পরিষদের কার্যনির্বাহী সভাপতি অতুল বরা বলেন, “শাসক দলের সঙ্গে অপরাধীদের যোগাযোগ ফের প্রমাণিত হল। এই চক্রে কারা জড়িত তা জানতে নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন।” খোদ কংগ্রেসের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা প্রবীণ বিধায়ক পৃথ্বী মাঝিও রুমির উপরে দায় চাপিয়েই বলেন, “গাড়ির পাস দেওয়ার আগে কাকে পাস দেওয়া হচ্ছে তার পরিচয় খতিয়ে দেখা বিধায়কের কর্তব্য। এই ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রুমির সঙ্গে অনিলের যোগাযোগ রয়েছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত হোক।”