নীতীশ কুমার ও চিরাগ পাসোয়ান
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের হাওয়া টের পেতেন তাঁর বাবা। কোন জোট বা দল ক্ষমতায় আসতে চলেছে, তা বুঝে আগেভাগেই তিনি তাদের সঙ্গে সমঝোতা সেরে ফেলতেন বলে মনে করত রাজনৈতিক শিবির। লোক জনশক্তি পার্টির প্রতিষ্ঠাতা রামবিলাস পাসোয়ানকে তাই রসিকতা করে রাজধানী বলত ‘হাওয়া মোরগ’।
তাঁর মৃত্যুর পর দলের ভার যাঁর কাঁধে, সেই ছেলে চিরাগ পাসোয়ানও যে পিতার যোগ্য রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী, তা প্রমাণ হল বিহার ভোটে। তবে তাঁর ক্ষেত্রে বিষয়টি কিছুটা আলাদা। আগাম হাওয়া আঁচ করে কারও জোট সঙ্গী হওয়া নয়। রাজনৈতিক সূত্রের মতে, চিরাগের খেলা আরও গভীর। ভোটের আগে হঠাৎ জেডিইউ-র সঙ্গ ছেড়ে ‘একলা চলো’-র যে সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন, তা ছিল নির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত। সূত্রের মতে, বিজেপি-র সঙ্গে বোঝাপড়া করে অথবা বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশেই চিরাগ পাসোয়ান নীতীশের দলের প্রার্থীদের দাঁড়ানো সমস্ত আসনে লড়াই করেছেন (১২২টি আসনে)। তিনি মোট প্রার্থী দিয়েছেন মোট ১৩৭টি আসনে। অর্থাৎ বিজেপি প্রার্থীর সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি সংঘাত নাম কি ওয়াস্তে মাত্র ১৫টি আসনে।
রাজনৈতিক শিবির বলছে, এটাই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের কৌশলী চাল। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা চাইছেন, বিহারে নীতীশের নিরঙ্কুশ দাপট ছেঁটে ফেলে সেখানে রাজ্যপাট দখল করতে। নীতীশের ভাবমূর্তিকে খাটো করতে। সেই কাজে চিরাগকে ব্যবহার করাটাই তাঁদের কাছে ছিল মোক্ষম অস্ত্র। পাশাপাশি বিজেপি-র এই হিসেবও ছিল, চিরাগ দাঁড়ালে কোন কোন বিধানসভা কেন্দ্রে এনডিএ-বিরোধী ভোট ভাগ হবে। নীতীশের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ অনুচর, প্রাক্তন জেডিইউ নেতা পবন বর্মার কথায়, ‘‘চিরাগ পাসোয়ানকে কাজে লাগিয়ে নীতীশ কুমারকে ছোট জোট শরিকের পর্যায়ে নামিয়ে আনল বিজেপি।’’
আরও পড়ুন: নীতীশ কি কুর্সি ছাড়বেন বড় শরিক বিজেপিকে
এ বারের ভোট প্রচারে চিরাগ আগাগোড়া নীতিশের বিরুদ্ধে ক্রমাগত তোপ দেগে গেলেও নিজেকে নরেন্দ্র মোদীর ‘হনুমান’ হিসেবেই বর্ণনা করেছেন! কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, খোদ নীতীশের শত অনুরোধ সত্ত্বেও বিজেপি-র কোনও বড় নেতাকে চিরাগের বিরুদ্ধে ভোট প্রচারে মুখ খুলতে দেখা যায়নি। নীতীশকে প্রস্তাবিত মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরলেও এই বিষয়ে জোটধর্ম পালন করেননি বিজেপি নেতারা।
প্রশ্ন উঠছে, বিজেপি-র হয়ে ব্যাটিং করে, নীতীশকে ডুবিয়ে (তৃতীয় স্থানে চলে গিয়েছে জেডিইউ) কি লাভ হল চিরাগের? কারণ জেডিইউ-র ভোট কাটলেও বিহার বিধানসভা আসনের মানচিত্রে নিজেদের লাভের ঘরে শূন্যই চিরাগের দলের। রাজনৈতিক সূত্রের মতে, বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বাবা রামবিলাসের জায়গায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব (খাদ্য গণবন্টন ও উপভোক্তা মন্ত্রক) দেওয়ার প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে চিরাগকে। অনেকেই বলছেন, এই চালটি দিয়ে আসলে এক ধরনের জুয়া খেলেছে বিজেপি, যা তাদের জন্যও বিপজ্জনক। কারণ নীতীশকে খাটো করতে গিয়ে এনডিএ জোটের অনেক আসন হাতছাড়া হয়ে চলে গিয়েছে বিরোধী শিবির, বিশেষ করে তেজস্বী যাদবের দিকে। রাজনৈতিক সূত্রের মতে, নয়তো এত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দেখা যেত না বিহার ভোটের ফলাফলে। অনায়াসেই অনেক বেশি আসন পেত এনডিএ-জোট।
আরও পড়ুন: বিহারে ৫ আসন দখল, তৃণমূলকে ভাবাচ্ছে ওয়েইসির দল
গভীর রাত পর্যন্ত চলা গণনার হিসেব দেখলেই স্পষ্ট, কী ভাবে বহু আসনে নীতীশের দলকে হারিয়ে দিয়েছে চিরাগের লোকজনশক্তি পার্টি। কোথাও সরাসরি জেডিইউ-র ভোট কেটেছেন চিরাগ। কোনও কোনও কেন্দ্রে দেখা গিয়েছে, নীতীশের সঙ্গে তিনি জোটে থাকলে, তাঁর দলের প্রাপ্ত ভোটের সুবাদে জেডিইউ সহজেই সেখানে জিতে যেত। যেমন উত্তর-পূর্ব বিহারের আলাউলি কেন্দ্রে। সেখানে জেডিইউ-র সাধনা দেবী পেয়েছেন (রাত পর্যন্ত গণনা অনুযায়ী) ২৯.৬৬ শতাংশ ভোট। আর চিরাগের দলের প্রার্থী রামচন্দ্র সওদা টেনে নিয়েছেন ১৮ শতাংশ ভোট। ফলস্বরূপ এগিয়ে গিয়েছেন সেখানকার আরজেডি প্রার্থী। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে, নীতীশের পাশে চিরাগের সমর্থন থাকলে সহজেই আসনটি জেতার কথা ছিল এনডিএ-র। একই ভাবে ঝাঁঝা নির্বাচনী কেন্দ্রে আরজেডি এবং জেডিইউ-র মধ্যে ভোট পার্থক্য ৪ শতাংশেরও কম (রাত পর্যন্ত গণনায়)। মাঝখানে প্রায় ১১ শতাংশ ভোট নিয়ে চলে গিয়েছে চিরাগের দল।