Ration

অল্প খরচে কৃতিত্ব পুরোই, নয়া মোড়ক কি রেশনে

শুক্রবার রাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্তের পরে ঘোষণা হয়েছে, ১ জানুয়ারি থেকে এক বছর পুরোপুরি নিখরচায় রেশনে চাল-গম বিলি করা হবে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:৪০
Share:

সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনে কেন্দ্র খরচের বেশির ভাগ বহন করলেও রাজ্যগুলি কৃতিত্বে ভাগ বসাচ্ছিল। ফাইল চিত্র।

খরচ দু’আনাও বাড়বে না। কিন্তু কৃতিত্ব মিলবে ষোলো আনাই। এই বিষয়টি বুঝেই নরেন্দ্র মোদী সরকার পুরোপুরি নিখরচায় রেশন বিলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

Advertisement

শুক্রবার রাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্তের পরে ঘোষণা হয়েছে, ১ জানুয়ারি থেকে এক বছর পুরোপুরি নিখরচায় রেশনে চাল-গম বিলি করা হবে। এই ঘোষণার পরে মোদী সরকার তথা বিজেপির নেতারা প্রচারে নেমে পড়েছেন। খাদ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল বলেছেন, মোদী সরকার এ জন্য বছরে ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি খরচ করবে। কিন্তু সরকারি সূত্র বলছে, এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের মাত্র ১৮,৫০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। খাদ্য ভর্তুকিতে এখন কেন্দ্রীয় সরকারকে যে টাকা খরচ করতে হয়, তার ১০ শতাংশেরও কম।

সামান্য বাড়তি খরচে নিখরচায় রেশন বিলি করে মোদী সরকার এ বার জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের পুরো কৃতিত্ব নিজের ঝোলায় পুরতে চাইছে। সরকারি সূত্রের খবর, গোটা দেশে নিখরচায় একই পরিমাণ রেশন বিলি করে মোদী সরকার একে ‘এক রাষ্ট্র, এক দাম, এক রেশন’ (ওয়ান নেশন, ওয়ান প্রাইস, ওয়ান রেশন) হিসেবে তুলে ধরবে। ভবিষ্যতে এই প্রকল্পকে প্রধানমন্ত্রীর নামে ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব অন্ন সুরক্ষা যোজনা’ নামকরণ করে নতুন মোড়কে চালু করার প্রস্তাবও রয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই ঘোষণা করতে পারেন।

Advertisement

সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা, জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনে কেন্দ্র খরচের বেশির ভাগ বহন করলেও রাজ্যগুলি কৃতিত্বে ভাগ বসাচ্ছিল। এত দিন জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় দেশের ৮১.৩৫ কোটি মানুষকে রেশনে ৩ টাকা কেজি করে চাল, ২ টাকা কেজি করে গম দেওয়া হচ্ছিল। এর মধ্যে অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনার অধীন পরিবারগুলি পায় মাসে ৩৫ কেজি চাল বা গম। অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকা পরিবারগুলিকে মাথা পিছু ৫ কেজি করে চাল বা গম দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু রাজ্য নিজেদের খরচায় সামান্য বাড়তি রেশন দিচ্ছিল। কিছু রাজ্য আবার নিজেরা সামান্য ভর্তুকি দিয়ে আর একটু কম দামে চাল-গম দিচ্ছিল। পশ্চিমবঙ্গ, কেরলের মতো রাজ্য আবার পুরো রেশনই বিনামূল্যে দিচ্ছিল। ফলে কেন্দ্রের সঙ্গে এই রাজ্যগুলিও কেন্দ্রের কৃতিত্বে ভাগ বসাচ্ছিল। সাধারণ মানুষের পক্ষে কেন্দ্র বেশি অর্থ দিচ্ছে না রাজ্য, তার বাছবিচার করা মুশকিল হত। এখন কেন্দ্রীয় সরকারই পুরো খরচ বহন করবে। চাল-গমের পরিবহণ, রেশন ডিলারদের কমিশনের খরচও সবটাই কেন্দ্র দেবে। তার বিনিময়ে কেন্দ্রীয় সরকারই পুরো কৃতিত্ব নেবে।

তার জন্য কত খরচ হবে? সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা, রেশনে কম দামে চাল-গম বিলি করতে কেন্দ্রকে এখন বছরে প্রায় ১ লক্ষ ৫৯ হাজার কোটি টাকার খাদ্য ভর্তুকি দিতে হয়। চাল, গম, জোয়ার-বাজরার জন্য যে কেজি প্রতি ৩ টাকা, ২ টাকা ও ১ টাকা দাম নেওয়া

হয়, তা মোট খাদ্য ভর্তুকির মাত্র ৮%। বাকি ৯২% খরচ এমনিতেই কেন্দ্র দিচ্ছে। ওই দামটুকুও আদায় করা না হলে কেন্দ্রতে বাড়তি ১৩,৯০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। এর সঙ্গে যোগ হবে চাল-গম পরিবহণ ও রেশন ডিলারদের কমিশনের খরচ। এখন উত্তর-পূর্ব ও পার্বত্য রাজ্যগুলি বাদে বাকি রাজ্যে কেন্দ্র অর্ধেক খরচ করে। যার পরিমাণ ৪৬০০ কোটি টাকা। রাজ্যের ভাগও কেন্দ্রকে দিতে হলে আরও ৪৬০০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। অর্থাৎ মোট ১৮,৫০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হবে। আরও কিছু জনমুখী প্রকল্পে খাদ্য জোগাতে কেন্দ্রকে প্রায় ২৩,৪২৭ কোটি টাকা খরচ করতে হয়। তা-ও এর মধ্যে মিশে গেলে সব মিলিয়ে মোদী সরকারের ২.০৫ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় হবে।

তবে মোদী সরকার প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ও করতে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন অর্থসচিব সুভাষচন্দ্র গর্গ বলছেন, ‘‘কোভিড-লকডাউনের পরে ২০২০-র মার্চে যে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা চালু হয়েছিল, তা ১ জানুয়ারি থেকে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।’’ এই যোজনায় বিনামূল্যে প্রতি মাসে ৫ কেজি করে বাড়তি রেশন দেওয়া হচ্ছিল। যাতে চলতি অর্থ বছরেই প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। গত ২৮ মাসে এর পিছনে প্রায় ৩ লক্ষ ৯১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। নীরবে সেই প্রকল্পে ইতি টানা হচ্ছে। রেশন ডিলারদের সংগঠন ‘অল ইন্ডিয়া ফেয়ার প্রাইস শপ ডিলার অ্যাসেসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক বিশ্বম্ভর বসু বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার শুক্রবারের সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষকে বোকা বানাচ্ছে। রেশন ডিলারদেরও সমস্যায় ফেলেছে। কারণ, বাড়তি রেশন দেওয়া হচ্ছিল বলে ডিলারদেরও কমিশন বাবদ বাড়তি আয় হচ্ছিল।’’ তাঁর দাবি, কোভিডের বিপর্যয় থেকে মানুষ এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাঁদের কথা ভেবে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার মেয়াদ বাড়ানো হোক।

কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রের খবর, তেমন কোনও সম্ভাবনা আর নেই। উল্টে মোদী সরকারের শীর্ষ কর্তারা মনে করছেন, সবাইকে নিখরচায় রেশন দিতে গিয়ে এখন বছরে প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হলেও ভবিষ্যতে তা কমে আসবে। কারণ, শেষ বার ২০১১-১২-য় যোজনা কমিশন দরিদ্রদের হিসেব কষে বলেছিল, তেন্ডুলকর কমিটির দারিদ্র সীমার হিসেব অনুযায়ী, দেশের ২১.৯% মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে রয়েছেন। সেই হিসেবে ৮১.৩৫ কোটি মানুষকে খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় এনে কম দামে রেশন দেওয়া হচ্ছে। তার পরে জনগণনা হয়নি। দারিদ্রের হিসেবও কষা হয়নি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের পলিসি রিসার্চ টিম ২০১৯-এ বলেছিল, দারিদ্রের হার ১০.২০ শতাংশে নেমে এসেছে। এ বার জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর (এনএসও) পরিবার পিছু খরচের সমীক্ষা শুরু করেছে। যার রিপোর্ট ২০২৩-এর ডিসেম্বরের মধ্যে চলে আসবে।

খাদ্য মন্ত্রকের এক কর্তা বলেন, ‘‘তখন দরিদ্রের সংখ্যা আরও কম বলে দেখা যাবে। ফলে ৮১.৩৫ কোটি মানুষকে আর বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে না। সেই কারণেই আপাতত ২০২৩-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত বিনামূল্যে রেশনের ঘোষণা হয়েছে। এর পরেও বিনামূল্যে রেশন চালু থাকতে হবে। তবে আমাদের অনুমান, তার সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা কমে আসবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement