নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কয়লা পাচারের মতো কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্ত বন্ধ করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের ধুয়ো তুলে মামলা করেছে বলে অভিযোগ তুললেন মোদী সরকারের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা।
পাল্টা জবাবে রাজ্য সরকারের হয়ে কপিল সিব্বল জানিয়ে দিলেন, রাজ্য সরকার সিবিআই তদন্তের ঢালাও অনুমতি প্রত্যাহারের পরে সিবিআইয়ের এক্তিয়ার থাকে কি না, সিবিআই তদন্ত শুরু করতে এফআইআর দায়ের করতে পারে কি না, তাঁরা শুধু এই সাংবিধানিক প্রশ্ন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে হাজির হয়েছেন। এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং কেন্দ্র-রাজ্য অধিকারের প্রশ্ন জড়িত।
২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রথমে অন্ধ্রপ্রদেশ, তার পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডি-র অপপ্রয়োগের অভিযোগ তুলে রাজ্যে সিবিআই তদন্তের ঢালাও অনুমতি বা ‘জেনারেল কনসেন্ট’ প্রত্যাহার করে নেয়। তার পরে একে একে বহু বিরোধী শাসিত রাজ্য দিল্লি স্পেশাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনের ছয় নম্বর ধারায় রাজ্যে সিবিআই তদন্তের অনুমতি প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু তার পরেও সিবিআই বহু তদন্তে এফআইআর দায়ের করেছে।
২০২১ সালে এর বিরুদ্ধেই কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ সংক্রান্ত সংবিধানের ১৩১ অনুচ্ছেদের আওতায় ‘অরিজিনাল সিভিল সুট’ দায়ের করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
আজ কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল মেহতা অভিযোগ তোলেন, সিবিআই পশ্চিমবঙ্গে রেলের জমি থেকে ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ডসের কয়লা পাচারের তদন্ত শুরু করেছিল। সেই তদন্তে ‘বিশেষ এক জনকে’ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকার উদ্যোগ নিতেই রাজ্য সরকার এই মামলা দায়ের করেছে। রাজ্য সরকার সিবিআই তদন্তের অনুমতি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সিবিআইয়ের তদন্ত করার এক্তিয়ার নেই বলে কয়লা পাচারের মূল অভিযুক্ত অনুপ মাঝি প্রথমে কলকাতা হাই কোর্ট, তার পরে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। রাজ্য সরকারও সেই মামলায় একই যুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু আদালত তদন্তে স্থগিতাদেশ দেয়নি। এ বার রাজ্য সরকারই সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের প্রশ্ন তুলে মামলা দায়ের করেছে। সিবিআই সারদা কেলেঙ্কারি থেকে কয়লা পাচার— নানা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে। রাজ্য সরকার চাইছে, আদালত সব তদন্তের এফআইআর খারিজ করে দিক। তাতে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হবে।
মেহতা যুক্তি দেন, এই মামলা ধোপেই টেকে না। কারণ এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের কোনও বিষয় জড়িত নয়। রাজ্যের অভিযোগ সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে। সিবিআই স্বাধীন সংস্থা। তারা এফআইআর দায়ের করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার বা কর্মিবর্গ মন্ত্রক এফআইআর দায়ের করেনি। কেন্দ্রীয় সরকার সিবিআই তদন্তে নজরদারি করে না। কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশন সিবিআইয়ের উপরে সার্বিক ভাবে নজরদারি করে। তাই সিবিআই ও কেন্দ্রীয় সরকার এক নয়। এই একই প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঝুলে রয়েছে। রাজ্য সরকার কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের মোড়কে ফের মামলা করেছে। আগের মামলা ঝুলে থাকার তথ্য রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে চেপে গিয়েছে। শুধুমাত্র এই কারণেই মামলা খারিজ করে দেওয়া উচিত। কার নির্দেশে মামলা দায়ের করা হয়েছে, কে ফাইলে সই করেছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় বলে মন্তব্য করেন মেহতা।
কেন্দ্রের এই অভিযোগের পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বি আর গাভাইয়ের বেঞ্চ প্রশ্ন তোলে— রাজ্য সরকার ঠিক কী চাইছে?
রাজ্য সরকারের আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, দিল্লি স্পেশাল পুলিশ এস্টাব্লিশমেন্ট আইনে বিজ্ঞপ্তি জারি করে সিবিআই তৈরি হয়েছিল। সিবিআই কোনও আলাদা আইনে তৈরি হয়নি। সে কারণে গৌহাটি হাই কোর্ট সিবিআইকে অসাংবিধানিক সংস্থা বলে রায় দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারই সেই রায়ের বিরুদ্ধে মামলা করে স্থগিতাদেশ চেয়েছে। সিবিআই কেন্দ্রের অধীনে। কেন্দ্রের নজরদারিতেই সিবিআই চলে। সিবিআইয়ের যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রের দিল্লি স্পেশাল পুলিশ এস্টাব্লিশমেন্ট আইন থেকে আসে। এখন রাজ্য সরকার সেই আইনেরই ধারা অনুযায়ী তদন্তের ঢালাও অনুমতি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। আইনত সেই অনুমতি প্রত্যাহারে পরে সিবিআই কোনও এফআইআর করতে পারে না। অথচ সিবিআই একের পর এক মামলায় এফআইআর করেছে। প্রশ্ন হল, সিবিআই কি রাজ্যের অনুমতি প্রত্যাহারের পরে নিজের ইচ্ছেমতো তদন্ত শুরু করতে পারে? সিবিআইয়ের কি সেই এক্তিয়ার রয়েছে?
সিব্বল বলেন, ‘‘এখানে সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত। এই প্রশ্নের সমাধান হওয়া প্রয়োজন। আমরা কোনও তদন্তে বাধা দিতে চাইছি না। কোনও তদন্তের নির্দেশ খারিজ করতে চাইছি না। সলিসিটর জেনারেলের বোঝার ভুল হচ্ছে। রাজ্য সরকার সিবিআইয়ের এফআইআর-কে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। সেটা অভিযুক্তরা করতে পারে। যে সব ক্ষেত্রে আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে, সে সব ক্ষেত্রেও আদালতের নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার এখানে আপত্তি তুলছে না। রাজ্য সরকার শুধু সিবিআইয়ের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।’’ সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, এই মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ নভেম্বর হবে।