প্রতীকী চিত্র।
তবে কি এ বার দাম না পেয়ে কৃষকের আত্মহত্যার খবর সংবাদপত্রের শিরোনাম থেকে মুছে যাবে? কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট বুধবার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের বদল মেনে নিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এ বার কৃষক যে বাজারেই দাম বেশি পাবেন সেখানেই তাঁর ফসল বিক্রি করতে পারবেন বলে খবর। তাতে কৃষকের উপকারই হওয়ার কথা। কৃষি বাজারের রাজনীতি থেকে যদি তাঁরা এই আইনের বলে সত্যিই মুক্তি পান, তবেই। কিন্তু এতে গণবণ্টন ব্যবস্থার উপর কী প্রভাব পড়বে তা আপাতত পরিষ্কার নয়। এবং তা অন্য আলোচনা দাবি করে।
কথায় বলে সমাজের স্মৃতি দুর্বল। জানি না, কত জন মনে করতে পারবেন পশ্চিমবঙ্গে ২০০৭ সালে কৃষিবিপণন আইন পরিবর্তন নিয়ে বিতর্কের কথা? তখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী। বাম আমল। তাঁর সময়েই আলুর ক্ষেত্রে চুক্তি চাষের অনুমতি দেয় রাজ্য সরকার। তা নিয়ে চারিদিকে ‘গেল গেল’ রব উঠেছিল। বাম সরকার কী করে পারল বাজারের হাতে কৃষককে ছাড়তে? কিন্তু এই আইনের কারণেই হুগলি থেকে শুরু করে আরও অনেক জেলার কৃষকই আলুর দামের অনিশ্চয়তার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
আর এই মুক্তি এসেছিল পেপসি-র হাত ধরেই। ১৮০০ কৃষকের সঙ্গে আগাম দামের চুক্তি করে পশ্চিমবঙ্গে তাদের ধুলাগড় কারখানায় যাত্রা শুরু করেছিল এই সংস্থাটি। আজ রাজ্যের প্রায় ছয়টি জেলার আলু চাষির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ এই সংস্থা। এই বছর পশ্চিমবঙ্গে নাকি ১০৫ লক্ষ টন আলু চাষ হওয়ার কথা। পেপসির ক্ষমতা ২ লক্ষ টন কেনার। যার ৩০ শতাংশই নাকি আসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে।
আরও পড়ুন: এক দেশ, এক কৃষি বাজার তৈরি করতে উদ্যোগ মোদী সরকারের, সায় কৃষিপণ্য মজুতেও
এই আলুর চাষের মোদ্দা কথাটা হল, কৃষকরা আগাম দামের প্রতিশ্রুতিতে চাষ শুরু করতে পারেন। চাষের পরে তাঁদের ভাবতে হয় না খরচটা তুলে লাভের মুখ দেখতে পারবেন কি না। এ রকম নয় যে এতেও কোনও সমস্যা নেই। আছে। তবে এই চুক্তি চাষে অন্তত আগামীর অনিশ্চয়তাটা এখন অনেক কম। অন্তত যাঁরা এই চুক্তিতে চাষের সুযোগ পেয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রে।
এগনো যাক এই গল্পের হাত ধরেই। মান্ডি পর্বে। কী সমস্যা এই মান্ডি নিয়ে? ষাটের দশকে ভারতে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ছিল অপ্রতুল। তাই সরকার অত্যাবশ্যকীয় আইনের আওতায় খাদ্যশস্য বাজার থেকে তুলে গণবণ্টন ব্যবস্থায় তা সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আমরা আজ যাকে রেশন বলি। আর করোনার সময়ে এই গণবণ্টন ব্যবস্থাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাধারণের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।
আরও পড়ুন: লকডাউন উঠছে, করোনার সংক্রমণ এড়াতে পথ দেখাচ্ছেন অটো চালক
কালোবাজারি রুখে চাষিদের হাতে সঠিক দাম আর আমার-আপনার ঘরে চাল ডাল ন্যায্য মূল্যে পৌঁছনোর এই ব্যবস্থা আবার আমাদের সমাজের নীতি মেনেই কৃষক বিরোধী ও কায়েমি স্বার্থের খেলা হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ।
অত্যাবশ্যকীয় আইনের আওয়তায় থাকা পণ্য কৃষকদের বিক্রি করতে হয় তাঁদের জন্য নির্ধারিত বাজারেই। অনেকেরই মনে থাকবে সাম্প্রতিক এক খবরের কথা। এক কৃষক তাঁর ক্ষেতের পণ্যে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একা নন। তাঁর মতো অনেকেই। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বাজার এত দুরে যে লকডাউনের বাজারে গাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে, মাল নিয়ে কৃষি বাজারে পৌঁছে যে দাম তিনি পাবেন তাতে তাঁর ক্ষতি বাড়বে বই কমবে না। তাই আগুন লাগাচ্ছেন তিনি।
আইন যদি অধিকার দিত তা হলে এই অবস্থায় তিনি অন্য কোথাও বিক্রি করতে পারতেন কি না সেই প্রশ্ন কেউ করেনি। তাই উত্তরটাও জানা নেই। কিন্তু এটা অনেকেই বলছেন, যে মান্ডি ব্যবস্থায় কৃষি বিপণন কিছু কায়েমি স্বার্থের তাঁবে চলে গিয়েছে। ঠিক যে কারণে এই আইনটি করা হয়েছিল, এই ব্যবস্থা আবার তাকেই নাকি ঘুরপথে ফিরিয়ে এনেছে।
কী ভাবে? প্রতিটি কৃষিবাজার চালায় একটি কমিটি। তার এক জন সচিব থাকে। কমিটি বাজার পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্রেতাদের লাইসেন্স দেওয়া থেকে আরম্ভ করে, দাম হাঁকার গোটা বিষয়টা পরিচালনা করে থাকে এই কমিটি। সচিব যদি সরকারি কর্মচারী হন, তা হলে তাঁর বেতন সরকার দেয়। অন্যথায় কমিটি।
কমিটি গঠনের এই প্রক্রিয়া থেকেই অনেক দিন ধরেই অভিযোগ যে কায়েমি স্বার্থ গেঁড়ে বসেছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে এই কমিটিই অনেক জায়গাতেই কৃষিস্বার্থ বিরোধী কাজ করে চলেছে। অর্থনীতিবিদ ইলা পট্টনায়েকের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, পণ্যের দাম যাতে ঠিক হয় আর কায়েমি স্বার্থ দানা না বাঁধতে পারে তা দেখতেই নিলাম ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এই নিলামে ক্রেতারা নিজেদের মধ্যে দর ঠিক করে নিচ্ছেন আগে থেকেই। সেই অনুযায়ীই দর হাঁকা হচ্ছে। যে ব্যবস্থা কৃষকের স্বার্থরক্ষার জন্য করা হয়েছে, সেই ব্যবস্থাই শেষে গিয়ে কৃষকের আত্মহত্যার কারণ হয়ে উঠছে।
নতুন ব্যবস্থায় কৃষিবাজার উঠে যাবে না। থাকবে। কৃষকরা চাইলে কৃষিবাজারেও বিক্রি করতে পারবেন তাঁদের পণ্য। আবার অন্য কোথাও বেশি দাম পেলে সেই বাজারেও বিক্রি করতে পারবেন তাঁদের উৎপাদন।
নতুন আইনে কি কৃষকরা লাভবান হবেন? ফাইল চিত্র।
আপাতদৃষ্টিতে এই ব্যবস্থা ভাল মনে হলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, ভারতে ক্ষুদ্র কৃষকের সংখ্যা প্রচুর। আর কৃষিতে কায়েমি স্বার্থ কিন্তু বিস্তৃত যার প্রভাব থেকে মান্ডি ব্যবস্থাও ছাড় পায়নি বলে বিভিন্ন সমীক্ষাতেই দেখা যাচ্ছে। ছোট কৃষকের কাছে কিন্তু বেশি দাম যেখানে পাওয়া যাবে সেই বাজারের সুযোগ নেওয়ার সুবিধা খাতায়কলমে পড়তে ভাল লাগলেও, বাস্তবে ততটা নয়। কতটা কম তা তো আমরা লকডাউনের সময় পণ্য জ্বালিয়ে দেওয়ার খবরেই প্রত্যক্ষ করেছি। তাই অন্য বাজারের বেশি দামের সুযোগ সাধারণ কৃষক পাবে তো? সাম্প্রতিক কালে রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি না-পাওয়া নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে, অভিযোগ উঠেছে ভর্তুকি নিয়ে অস্বচ্ছতারও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রেশন ব্যবস্থার হাল কী হবে তা-ও জানা প্রয়োজন। করোনা দেখিয়েছে গণবণ্টন ব্যবস্থা কতটা জরুরি। তা মাথায় রেখে এই সব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর কিন্তু জরুরি। পাব তো?