করোনা আতঙ্কে সুনসান রাস্তাঘাট। ছবি: পিটিআই
হয় করোনায় মরব অথবা না-খেয়ে মরব। কোথায় শুলাম তাতে কী এসে যায়! বৃহস্পতিবার আনন্দবাজারে এক কুলির এই বক্তব্যই কিন্তু করোনা নামক এই আপদ নিয়ে শেষ কথা।
মহিন্দ্রা মোটরসের অন্যতম কর্ণধার আনন্দ মহিন্দ্রা তাঁর সাম্প্রতিক টুইটে কিন্তু এই দিনমজুরের কথাটাই বলেছেন। তিনি বলেছেন, ভাইরাসকে আমরা সময়ে জয় করব। কিন্তু যে মূল্য আমাদের চোকাতে হবে তা অবর্ণনীয়। বিশেষ করে ছোট ব্যবসা, স্বনিযুক্ত বা দিন-আনি-দিন-খাই মানুষগুলোকেই সব থেকে বড় মূল্য চোকাতে হবে!
আমরা নিজে যত ক্ষণ না আহত হই, তত ক্ষণ আঘাতের গুরুত্ব বুঝতে চাই না। কিন্তু অবস্থা যে সত্যিই কতটা গভীর তা মহিন্দ্রা বোঝেন, কারণ ব্যবসা করেই তিনি কোটিপতি। তিনি বোঝেন বাজার চালু থাকার গুরুত্ব। যেমন ধরুন তরুণ মল্লিকের কথা। ক্ষুদ্র কিন্তু খুবই নাম করা ব্র্যান্ডের মালিক। আজ ফোনে বলছিলেন কী ভাবে আগামী দিনগুলো চলবে তা নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তার কথা।
আরও পড়ুন: কোথায় কোয়রান্টিন? বিদেশ থেকে ফিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন পুলিশ কর্তার ছেলে
তরুণ মল্লিকের কারখানায় তৈরি বিভিন্ন সুটকেস, ছাতা, ব্যাগ বিক্রি হয় তাঁর নিজের দোকান থেকে। কলকাতার তিনটে বড় মলে তাঁর উপস্থিতি। এ ছাড়াও তিনি বিক্রি করেন নানান অনলাইন বাজারে। গত তিন দিন ধরে কোনও বিক্রি নেই। এত বড় ব্যবসাও নয় যে এখন উৎপাদন চালু রেখে কর্মীদের মাইনে দিয়ে যেতে পারবেন। বাজার নেই। কবে ঘুরে দাঁড়াবে তারও কোনও ঠিকানা নেই। কোথা থেকে আসবে টিকে থাকার রসদ?
গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে রয়েছে জিএসটি। মার্চ মাস। চোকাতে হয়েছে বকেয়া। সরকার ছাড় দিলে ওই টাকায় কর্মীদের আরও কিছু দিন টেনে নেওয়া যেত। আবার মল মালিকরাও ছাড়বেন না। তাঁদের দাবিও মেটাতে হবে। এ মাসটা টেনে দিলেও আগামী দিনগুলো চলবে কী করে?
এই সংস্থাগুলোই দেশ চালায়। দেশের উৎপাদনের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মূল্যযুক্তি এদের কাছ থেকেই আসে। এরাই দেশের প্রায় ৪৫ শতাংশ কর্মীর রুজির উৎস। এই সংস্থাগুলো যদি মাইনে দিতে না পারে, তা হলে তার অভিঘাত বুঝতে কী খুব বেশি অঙ্ক বোঝার দরকার আছে?
আরও পড়ুন: আইসোলেশনেই তো ছিল, তার পরেও হেনস্থা কেন? প্রশ্ন করোনা আক্রান্ত তরুণীর পরিবারের
বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্রিনিং। ছবি: পিটিআই
একটু ফিরে দেখি। সবাই বলছে চিন যদি আগে চেপে না গিয়ে বিশ্বকে জানাত তা হলে হয়ত এই ভাইরাস এই ভাবে ছড়ানো রোখা যেত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনলজি ইনফরমেশনের নীতা মাধব তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে এই জাতীয় অতিমারীর (প্যানডেমিক) ঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করেন ২০১৭ সালে। তাঁদের বক্তব্য— ২০০৩ সালের সার্স বা ২০১৪ সালের পশ্চিম এশিয়ার ইবোলার আঘাত কমানো যেত যদি সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এই রোগের কথা চেপে না রেখে প্রথমেই তা প্রকাশ করে দিত। এই জাতীয় রোগের ক্ষতি আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগে অনেক কমানো যায় যদি একদম প্রথমেই রোগের কথা প্রকাশ্যে আসে।
নীতা মাধব ও তাঁর সহযোগীদের বক্তব্য, সার্সের পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) তার ‘ইন্টারন্যাশন্যাল হেল্থ রেগুলেশনে’ নানান বদল আনে। কিন্তু সেই নতুন নিয়ম সব সদস্য দেশ যে মেনে চলছে, তার কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং উল্টোটাই দেখা গিয়েছে ইবোলার ক্ষেত্রে। আর এ বার আমরা দেখলাম করোনার ক্ষেত্রে। এবং প্রতি বারই এই জাতীয় অতিমারীর উৎস হিসাবে উঠে আসছে সেই সব দেশ, যারা সব সময়ই তথ্য গোপনের অভিযোগে অভিযুক্ত। এই বার এর আঘাত কিন্তু আরও বেশি, আরও গভীর হতে চলেছে। এবং তারও উৎস সেই তথ্য গোপনের অভিযোগে চিরকালই অভিযুক্ত থাকা চিন।
ফেরা যাক অভিঘাতে। স্প্যানিশ ফ্লু, বার্ড ফ্লু, বা ইবোলার মতো অসুখ বাজারকে কী ভাবে আঘাত করে তা নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে— যদি ১ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ এ জাতীয় ভাইরাসের কোপে পড়েন এবং তাঁদের ২.৫ শতাংশ মারা যান, তা হলে তাৎক্ষণিক জিডিপি পড়বে ১.১ শতাংশ। এবং তার পরে বেশ কিছু বছর বৃদ্ধির হার ০.৫ শতাংশের উপরে যাওয়া নিয়ে সংশয় আছে।
ভারতের কী হবে? ইতিমধ্যেই তথ্যপ্রযুক্তি এবং বিমান সংস্থাগুলি মাইনে কমানোর কথা ঘোষণা করে দিয়েছে। বাজারে চাহিদা আরও কমবে। এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে দেশে বিনিয়োগ কম। সরকার আর্থিক নীতি-বৈকল্য নিয়ে প্রশ্নের মুখে। তার উপরে করোনা। সংস্থাগুলো সরকার বলার আগে নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। যেখানে সম্ভব সেখানে বাড়ি থেকে কাজ করা গত সপ্তাহ থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন: ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা স্থগিত
করোনা আতঙ্কে বন্ধ বাজার। ছবি: পিটিআই
কিন্তু এক দিকে বাজার মুখ থুবড়ে পড়েছে, অন্য দিকে সরকারি কর-সহ অন্যান্য দায় মেটানোয় কোনও রেহাই নেই । এমতাবস্তায় বড় সংস্থা টিঁকে যাবে। কিন্তু ক্ষুদ্র সংস্থার সে রেস্ত থাকে না, যা দিয়ে তারা তিন মাসের উপর আয় ছাড়াই ব্যয়ভার বহন করে চলবে। তার ফল? ছাঁটাই। কত জন তা বোঝা যাবে কত দিন এই চাপ চলবে তা থেকেই।
আর এই চাপ অন্য দেশের থেকেও আমাদের দেশে বেশি দিন চলতে পারে। ইউরোপের দারিদ্র আর আমাদের দেশের দারিদ্র চরিত্রগত ভাবেই আলাদা। আমাদের দারিদ্র ওই কুলির কথাতেই প্রকাশিত। একই সঙ্গে আমরা যে জাত হিসাবে খুব সচেতন তা নিন্দুকেও বলতে পারবে না। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ বিদেশ থেকে এই রোগ নিয়ে আসা শিক্ষিত মানুষের ব্যবহার।
আর এই খানেই সমস্যার আর এক মোড়। নীতা মাধবরা বলছেন, সমস্যা বেশি সেই সব দেশের যেখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। সেখানে লড়াইটা গিয়ে দাঁড়ায় সচেতনতা তৈরি এবং অসুস্থ না-হওয়ার প্রচেষ্টায়। সরকারকে সেখানে স্বচ্ছ হতে হবে। কিন্তু সচেতনতা যাঁরা গড়বেন সেই স্তরের মানুষই যদি রোগ ছড়ানোর কারণ হয়ে দাঁড়ান, তা হলে? আর সরকার যদি স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে সুনামের অধিকারী না হয়, তা হলে?
আরও পড়ুন: রাজ্যে তৃতীয় করোনা আক্রান্ত স্কটল্যান্ডফেরত হাবড়ার তরুণী
আর এই প্রশ্নেই শুরু হয়েছে আর এক আর্থিক অনিশ্চয়তার জায়গা। কোষাগারের স্বাস্থ্য যে খুব উজ্জ্বল নয় তা আমরা জানি। সরকার কিন্তু জিএসটি ফাইলিং নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত জানায়নি। এই মুহূর্তে ক্ষুদ্র ব্যবসার কাছে সমস্যা হল নগদের। বাজারে বিক্রিতে মন্দা হলে নগদের টানাটানি হবেই। সরকার— কেন্দ্র এবং রাজ্য— যদি দ্রুত করোনা সমস্যার মোকাবিলা না করতে পারে তা হলে বাজার একেবারেই শুয়ে পড়বে। তার শয্যাসঙ্গী হবে আনন্দ মহিন্দ্রার আশঙ্কার ক্ষেত্রগুলোই। সরকার কিন্তু এখনও করোনা নিয়ে ‘ঘরবন্দি’ বা ‘স্প্যানিস তালি’-র বাইরে কিছু বলে উঠতে পারেননি।
করোনা কিন্তু ধর্মের রঙ মানবে না। তাই সময় এসেছে ভাবনার, আমরা ওরা ছেড়ে, সমস্যার মোকাবিলায় গণতান্ত্রিক চিন্তার। কিন্তু তা কী হবে? নাকি কুলির ওই উক্তির মধ্যেই আমাদের সামাজিক দর্শনের সারবত্তা খুঁজে যেতে হবে?