রণক্ষেত্র: নয়া নাগরিকত্ব আইন বিরোধী সমাবেশ ঘিরে পুলিশ-বিক্ষোভকারী সংঘর্ষ নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া গেটের সামনে। মাটিতে পড়ে আহত প্রতিবাদী। ছবি: পিটিআই
এনআরসি ও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-বিরোধী সমাবেশ ঘিরে আজ আবার উত্তপ্ত দিল্লি। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে তাণ্ডবের পরে এ বার পুরনো দিল্লির দরিয়াগঞ্জে ‘ঢুকে’ লাঠি চালানো ও নাবালকদের থানায় আটকে রাখার অভিযোগ উঠল পুলিশের বিরুদ্ধে। ইন্ডিয়া গেটের জমায়েতেও পুলিশ লাঠি চালিয়েছে বলে অভিযোগ। যার জেরে রাতে দিল্লি পুলিশের সদর দফতরের সামনে ফের বিশাল বিক্ষোভ শুরু হয়। হাজারখানেক লোক জড়ো হয়ে আটকদের ছাড়ার দাবি তোলেন। বিক্ষোভকারীরা মূলত পড়ুয়া।
দরিয়াগঞ্জ থানার বাইরে জড়ো হওয়া আইনজীবীদের অভিযোগ, ৮ জন নাবালক এবং আরও জনা কয়েক তরুণকে থানায় আটকে রাখা হয়েছে। লাঠির ঘায়ে অনেকেই আহত। কিন্তু চিকিৎসক, আইনজীবী বা পরিবারকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিয়োয় দেখা যায়, পুলিশ দরিয়াগঞ্জের গলিতে ঢুকে লাঠি চালাচ্ছে। পুলিশের দাবি, পাথর ছোড়ার অভিযোগে কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে। রাতে মধ্য দিল্লির মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট নির্দেশ দেন, আটক হওয়া সবাইকে তাঁদের আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করতে দিতে হবে। আহতদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, নাবালকদের থানায় আটকে রাখাটা বেআইনি। এই নির্দেশের পরে নাবালকদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
আজ দুপুরে জামা মসজিদের সামনে এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)-বিরোধী সমাবেশে দলিত সংগঠন ভীম আর্মির প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদ কার্যত নাকানিচোবানি খাওয়ান দিল্লি পুলিশকে। আজাদকে বিক্ষোভ দেখাতে দেওয়া হবে না, এই পণ করে প্রহরা বসালেও গোহারা হারে পুলিশ। কিন্তু বিকেলে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নেয়। একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। তার পরে জলকামান ছোড়ে পুলিশ, লাঠিও চালায়। সংঘর্ষে দু’পক্ষেরই বেশ কয়েক জন আহত হন। অভিযোগ, পুলিশ মেয়ে-শিশুদেরও রেয়াত করেনি, যাকে সামনে পেয়েছে, মেরেছে। রাস্তায় ফেলে মাথা লক্ষ্য করে মারা হয়েছে। সংবাদ সংস্থার তোলা ছবি এবং ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, রাস্তায় চাপ চাপ রক্ত। কোনও রাস্তায় পড়ে রয়েছে সারি সারি চটি। দিল্লি পুলিশের মুখপাত্র এম এস রণধাওয়া বলেন, ‘‘বিকেল ৫টার পর থেকে বহিরাগতরা এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে। গাড়িতে আগুন লাগায়।’’
পুরনো দিল্লি ও নয়াদিল্লির বিভিন্ন অংশে আজ পথে নামেন সাধারণ মানুষ। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ দেখান ছাত্রছাত্রীরা। সন্ধ্যায় ইন্ডিয়া গেটে বড় মাপের প্রতিবাদ মিছিল হয়। পুলিশ সেখানেও লাঠি চালিয়ে
তাদের ছত্রভঙ্গ করে। এই ঘটনার নিন্দা করে বার্তা দেন সনিয়া গাঁধী। সাধারণত, প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি যে-ভাবে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন, অনেকটা সেই ভঙ্গিতে এক ভিডিয়ো বার্তায় তিনি বলেন, ‘‘গণতন্ত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত ও নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলার অধিকার রয়েছে মানুষের। কিন্তু বিজেপি সরকার জনগণের সেই কণ্ঠস্বরকে অগ্রাহ্য করছে, তা থামানোর জন্য কঠোর দমননীতির রাস্তা নিয়েছে।’’ ইন্ডিয়া গেটের বিক্ষোভ-সমাবেশে মেয়ে মিরায়াকে নিয়ে যোগ দেন প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা। তিনি বলেন, ‘‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন গরিব-বিরোধী। ধনীদের কাগজপত্র আছে। কিন্তু নোট বাতিলের মতোই গরিবদের এ বার কাগজের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হবে।’’
আজ সকাল থেকে বিকেলের ঘটনাক্রমের কেন্দ্রে ছিলেন আজাদই। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তিনি জানান, জুম্মার নমাজের পরে দিল্লির জামা মসজিদ চত্বরে এনআরসি ও নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যাবেন তিনি। যন্তরমন্তর পর্যন্ত মিছিল করবেন। ভিড় যাতে জামা মসজিদ এলাকায় পৌঁছতে না-পারে, সেই জন্য সকালেই বন্ধ করে দেওয়া হয় মসজিদ সংলগ্ন তিনটি মেট্রো স্টেশন। পরে ১৬টি মেট্রো স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেটও। তবে প্রতিবাদ থামানো যায়নি।
দলিত নেতাকে আটকাতে আজ মসজিদের সব প্রবেশপথের সামনে ব্যারিকেড করে পুলিশ। ছবিটা বদলে যায় বেলা দেড়টা নাগাদ। নমাজের পরে মসজিদের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখা যায় এক যুবককে। হাতে অম্বেডকরের ছবি। ভিড় ঠেলে তিনি সামনে আসতেই চমকে ওঠেন দিল্লি পুলিশের আধিকারিকেরা। কিছু ক্ষণ আগেই তো ওয়াকিটকিতে শোনা গেল, আজাদ আটক। তা হলে! ভুল ভাঙে সামান্য পরেই। তত ক্ষণে টুইটও চলে এসেছে আজাদের। লিখেছেন, ‘‘আমার গ্রেফতারির খবর ভুয়ো। জামা মসজিদ পৌঁছচ্ছি।’’ এক সমর্থক পরে টুইট করে জানান, আজাদকে মসজিদের বাইরে আটক করেছিল পুলিশ। কিন্তু স্থানীয় মানুষের প্রতিরোধের সুযোগে এক ছাদ থেকে আর এক ছাদে লাফিয়ে, কার্নিস ধরে দৌড়ে মসজিদে ঢুকে পড়েন তিনি।
সরকার-বিরোধী স্লোগানে তখন উত্তাল গোটা চত্বর। জাতীয় পতাকা ওড়ানো উত্তেজিত জনতা দলিত নেতাকে দেখেই সাদরে বরণ করে নেয়। জামা মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশটি পাঠ করেন আজাদ। গলা মেলান বিক্ষোভকারীরা। বেলা ২টো নাগাদ জামা মসজিদের দু’নম্বর গেট দিয়ে বেরোয় মিছিল। পুরোভাগে ছিলেন আজাদ। সেখানেও তাঁকে এক বার প্রায় ঘিরে ফেলে সাদা পোশাকের পুলিশের একটি দল। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মিশে গিয়ে পুলিশকে ফাঁকি দেন আজাদ। কিছু পরে ফের মিছিলে হাতে সংবিধান ও অম্বেডকরের ছবি নিয়ে হাঁটতে দেখা যায় তাঁকে।
মিছিল অবশ্য দরিয়াগঞ্জের কাছে দিল্লি গেটের সামনে আটকে দেয় পুলিশ। তারা লাঠি চালানোর পরে বিক্ষোভকারীদের একাংশ পালিয়ে যন্তরমন্তরে চলে যান। তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যান প্রিয়ঙ্কা। রাত যত বেড়েছে, বিক্ষোভও বেড়েছে। জামা মসজিদ চত্বরে ফের গিয়েছেন আজাদ। আর দিল্লি পুলিশের দফতরের সামনে জড়ো হয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা।