গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি করতে চায়। সে কারণে সম্প্রতি সংসদে নাগরিকত্ব আইনে সংশোধনও করেছে তারা। যুক্তি, অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করতে নাগরিক পঞ্জি অত্যন্ত জরুরি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার একেবারেই জাতীয় নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে। সংসদে পাশ হওয়া সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধেও তারা। যুক্তি, যাঁরা ইতিমধ্যেই দেশের নাগরিক, তাঁদের আবার পঞ্জি কিসের?
ফলে, কেন্দ্র এবং রাজ্য আপাতত এই ইস্যুতে কার্যত সম্মুখ সমরে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান নরেন্দ্র মোদী। রাজ্য সরকারের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনের অবস্থান এই মুহূর্তে ঠিক ভিন্ন মেরুতে।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দু’পক্ষের ‘রণং দেহি’ মেজাজের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে দুটো ভিডিয়ো। যেখানে দেখা যাচ্ছে, যে ‘নাগরিক’ নিয়ে এই মুহূর্তে দু’জন এক্কেবারে সম্মুখসমরে, সেই ইস্যুতেই নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক দিন নিজেদের একদম উল্টো অবস্থানে ছিলেন। মোদী তখন মনমোহন সিংহকে সরিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইয়ে। আর মমতা বাংলা থেকে বামশাসন উৎখাতের অস্ত্রে শান দিচ্ছেন। ওই ভিডিয়োয় মোদীর মুখে শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে অসমের সব ডিটেনশন ক্যাম্প ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন। আর দ্বিতীয় ভিডিয়োয় মমতা দাবি করছেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে দেশছাড়া করতে হবে।
প্রথম ভিডিয়োটি ২০১৪-র। নরেন্দ্র মোদী তখনও প্রধানমন্ত্রী হননি। শেষ লগ্নে এসে তীব্র প্রশাসন-বিরোধী হাওয়া এবং সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগে জর্জরিত মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার। উল্টো দিকে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী— প্রায় গোটা দেশে তীব্র মোদী হাওয়া। দেশ কার্যত ধরেই নিয়েছে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। তুঙ্গে ভোটপ্রচার। সেই সময়ে প্রচারে অসমে গেলেন মোদী। সেখানে একটি নির্বাচনী জনসভায় তিনি সদর্পে ঘোষণা করেন, ক্ষমতায় এলে অসমের সমস্ত ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন।
২০১৪ সালে অসমে মোদীর সেই বক্তব্যের ভিডিয়ো।
দ্বিতীয় ভিডিয়োটি ২০০৫-এর। কেন্দ্রে মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে ইউপিএ-১ সরকার চলছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন এনডিএ জোটে থাকা তৃণমূলের সাংসদ। লোকসভায় সেই সময় চলছে বাদল অধিবেশন। তার মধ্যেই ৪ অগস্ট অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিতকরণ এবং বিতাড়নের দাবিতে লোকসভায় মুলতুবি প্রস্তাব জমা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু, তা খারিজ হয়ে যায়। স্পিকার যদিও সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, কিন্তু সে দিন অধিবেশনের সেই সময়ে স্পিকারের চেয়ারে ছিলেন তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার চরণজিৎ সিংহ অটওয়াল।
তাঁর মুলতুবি প্রস্তাব কেন বাতিল হয়েছে, জানতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুপ্রবেশকারী ইস্যুতে বলতে বলতেই আচমকা ওয়েলে নেমে তিনি সোজা চলে আসেন স্পিকারের চেয়ারের সামনে। ডেপুটি স্পিকারের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করেন, জনগণের ইস্যু নিয়ে কেন তাঁকে বলতে দেওয়া হচ্ছে না— ইত্যাদি। কথা বলতে বলতে হঠাৎই ডেপুটি স্পিকারকে লক্ষ্য করে মমতা ছুড়ে মারেন তাঁর হাতে থাকা এক গোছা কাগজ। কিছু ক্ষণ পরে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফাও দিয়ে দেন। যদিও সেই ইস্তফাপত্র গৃহীত হয়নি।
২০০৫ সালে লোকসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ঘটনার ভিডিয়ো:
তার পর যমুনা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক অনেক জল গড়িয়েছে। মোদী ২০১৪-তেই প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ২০১৯-এ ফের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফের প্রধানমন্ত্রীর আসনে। তাঁর আমলেই অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি হয়েছে। সেই তালিকায় বাদ পড়েছে প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষের নাম। তার পর থেকে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে চলছে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির কাজ। ঘটনাচক্রে তা হচ্ছে মোদীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই। তার আমলেই সংসদে পাশ হয়েছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনও। অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করতে গোটা দেশে তাঁর সরকার এখন জাতীয় নাগরিক পঞ্জির পথে।
অন্য দিকে, মমতা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন ২০১১ সালে। ২০০৫-এ যে মমতা অনুপ্রবেশকারী প্রসঙ্গে সংসদে গলা ফাটিয়েছিলেন, সেই তিনিই অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জির বিরোধিতা করেছেন। আর এ রাজ্যে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি করতে দেবেন-ই না, কার্যকর করবেন না সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন— রীতি মতো ঘোষণাও করেছেন তিনি। এই ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কার্যত জেহাদ ঘোষণা করে লাগাতার পথে নামছেন। বলছেন, এ রাজ্যে এনআরসি করতে হলে তাঁর লাশের উপর দিয়ে করতে হবে।
সোশাল মিডিয়ায় যে ভিডিয়ো ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নিয়ে কী বলছেন মমতা? বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘‘সিপিএম আমলে একদল লোকের ভোটার কার্ড ছিল না। তাও তারা ভোট দিয়ে যেত। আমরা দাবি তুলেছিলাম, নো আইডি কার্ড, নো ভোট। সেটা নিয়ে সংসদে বলেছিলাম। অনেক আন্দোলন করে এই জায়গায় এসেছি। ফেক ভিডিয়ো ছড়াবেন না।’’