গত বছরের কেন্দ্রীয় বাজেট ছিল কিছুটা উদ্বেগের বাজেট। তার আগেই সাধারণ ভারতবাসী ‘নোটবন্দি’র মতো একটা ধাক্কার সম্মুখীন হয়েছে। সেটা কী করে সামলানো যায়, তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে অর্থমন্ত্রী সবাই বাজেটের আগেই নানা রকম পদক্ষেপ করে ফেলেছিলেন।
২০১৭-১৮ আর্থিক বছরে ‘নোটবন্দি’র মতো সে রকম ঘটনা না ঘটলেও, দেশ দেখেছে কর ব্যবস্থায় এক বিরাট পরিবর্তন। সেটা হল ‘জিএসটি’ বা পণ্য পরিষেবা কর। এই ব্যবস্থায় যে কোনও পণ্য পরিষেবা উৎপাদনকারী ব্যক্তি বা সংস্থাকে তার নিজস্ব দেয় কর সঠিক ভাবে দিতে গেলে, তার উৎপাদনে যা কিছু উপাদান ব্যবহার হয়েছে তার হিসাব জানাতে আইনত বাধ্য।
সমস্যা হল একটাই— যদি এই ব্যবস্থার মধ্যে অসংগঠিত ক্ষেত্র ঢুকে পড়ে, তা হলে তার তো হিসাব নথিবদ্ধ করাই মুশকিল। অথচ জিএসটি সারা ভারতে পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে শুধু সমান হারে করই চালু করেনি— সারা দেশে যেখান থেকেই উৎপাদনের উপাদান সংগ্রহ করা হোক, তা কর নির্ধারণে কাজে লাগানো হবে।
নোটবন্দি দেশের উৎপাদক এবং ভোক্তা, দু’দলকেই নাড়া দিয়েছিল। জিএসটি প্রত্যক্ষ ভাবে নাড়া দিয়েছে প্রধাণত উৎপাদকদের। কারণ, করের বোঝা প্রথমে তাদের ঘাড়েই পড়ে। কিন্তু আমাদের দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্র ব্যাপক, এবং মূলত ছোট উৎপাদকদেরই প্রাধান্য এখানে। জিএসটি দু’ধরনের উৎপাদককেই আঘাত করেছে— পণ্য ও পরিষেবা। তত্ত্বগত ভাবে এর ভিত্তি আছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। যে কোনও জিনিসের উৎপাদন, পরিষেবা ছাড়া ভোক্তার কাছে শেষ লপ্তে পৌঁছয় না। সুতরাং, করের হার একই হওয়া উচিত। কিন্তু, অসংগঠিত ক্ষেত্র তো কোনও দিনই কর দেয়নি। সরকারি কর বা বেসরকারি খাজনা তাদের দিতে হয়ই না বলা চলে।
সারা দেশে ৮০ শতাংশের উপর উৎপাদক কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে এবং মোট জাতীয় উৎপাদনের আনুমানিক ৪০ শতাংশ তাঁরা উৎপাদন করেন। শেষ অঙ্কে যে দ্রুততার সঙ্গে জিএসটি চালু হয়েছে সেই দ্রুততার সঙ্গে কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্র তাদের নিজেদের সরকারি ভাবে করযোগ্য করে তুলতে পারেনি। এতএব, দেশে একটা বিরাট অংশ এক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে গিয়েছে— সে কৃষি বা শিল্প পরিষেবা যাই হোক। এরা আবার অনেকেই বড় শিল্পের উপাদান সরবরাহকারী হিসাবে কাজ করে— সে বস্ত্রশিল্প, অলংকার শিল্প, ইলেকট্রনিক বা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প যাই হোক না কেন। জিএসটিতে নথিবদ্ধ করতে গিয়ে বড় শিল্প এদের অনেকের থেকে তার হাত তুলে নিয়েছে, যেহেতু সব কিছু উপাদান নথিবদ্ধ না হলে সে জিএসটির সুযোগ পাবে না।
এর ফল হয়েছে দু’প্রকার। বেশ কিছু অসংগঠিত ক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। বাজার মূল্যে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার ২০১৬-১৭-র প্রথম দুই ত্রৈমাসিকের তুলনায় যথেষ্ট কম। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ২০১৬-১৭তে এটা ছিল ৭.৫ শতাংশ আর ২০১৭-১৮তে তা হয়েছে ৬.৩ শতাংশ। আর এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে এই হার ছিল যথাক্রমে ৭.৯ শতাংশ আর ৫.৭ শতাংশ। এই হ্রাস কিন্তু শুধু জিএসটির জন্য নয়— এটা নিশ্চয় ‘নোটবন্দি’র দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবও বটে, কারণ জিএসটি চালু হয়েছে ১লা জুলাই ২০১৭ থেকে। কিন্তু, জিএসটির প্রভাবও যে অসংগঠিত ক্ষেত্রে পড়েছে তা বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞেরই মত।
অন্য চিন্তার ব্যাপার হয়েছে জিএসটির ফলে কর আদায়ের ক্ষেত্রে। সরকারি তথ্য বলছে— গত জুলাই মাসে জিএসটি থেকে কর আদায়ের পরিমাণ যেখানে ছিল ৯৮,০৬৩ কোটি টাকা, তা নভেম্বর মাসে কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮০,৮০৮ কোটিতে। সরকার এর পিছনে দু’টি প্রধান যুক্তি দেখিয়েছে— এক হল জিএসটি হার অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে কমানো হয়েছে আর দ্বিতীয়ত, ছোট অসংগঠিত উৎপাদকরা অনেক কম সংখ্যায় নাম নথিবদ্ধ করছে।
এমতাবস্থায় বাজেটের গুরুত্ব এক দিক দিয়ে কমেছে। কারণ জিএসটি কী হারে পণ্য ও পরিষেবার উপরে লাগু হবে তা এখন ঠিক করছে জিএসটি কাউন্সিল। অতএব বাজেট নিয়ে মানুষের যে উৎসাহ থাকত কোন জিনিসের উপরে কর কমানো হল এই সূত্রে তা এখন নেই। কিন্তু, তাই বলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জিএসটি থেকে কত কর আদায় হল তার গুরুত্ব তো হ্রাস পায়নি।
এই বিষয়ে বলা যায় সরকার তিনটি সূত্রে তার রাজস্ব পায়। এক— কর যা অপ্রত্যক্ষ (মানে জিএসটি বা পেট্রোপণ্যের উপর যে বিক্রয় কর) বা প্রত্যক্ষ (যা আমাদের আয় বা সম্পদের উপর লাগু হয়); দুই— কর নয় এ রকম আয় (যা আসে নানা রকম শুল্ক বা ফি ইত্যাদির মাধ্যমে) আর তিন— ঋণ নয় এ রকম আয় থেকে (যেমন সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থার বিলগ্নীকরণ)। এত সব করেও যখন আয় ব্যয়ের থেকে কম হয়, তখন সরকারের বাজেট ঘাটতি হয় এবং তা পূরণ করতে সরকারকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা জনগণের কাছ থেকে ঋণ নিতে হয়। এই মুহূর্তে এই ঘাটতির মোট পরিমাণ জাতীয় আয়ের শতাংশে গত বাজেটে যা প্রত্যাশিত সেই ৩.২ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ঘাটতির পরিমাণ বেশি হওয়ার পিছনে অর্থনীতির শ্লথগতি এবং নতুন কর ব্যবস্থা নিশ্চয় কিছুটা পরিমাণে দায়ী। আর সরকার যদি ঘাটতিতে চলে, তবে ব্যাঙ্কগুলির উপরে চাপ বাড়ে সরকারকে ধার দেওয়ার এবং তাতে বেসরকারি ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ আরও কমে যেতে পারে।
সরকার এই অবস্থার মোকাবিলায় বাজেটে কি পদক্ষেপ নিতে পারে? প্রথমত, অপ্রত্যক্ষ কর এখন জিএসটি কাউন্সিলের উপর নির্ভরশীল এবং যেহেতু এ ক্ষেত্রে এখনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, এই সূত্রে আয় বাড়ার সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয় হল, প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্র। সরকারের আশা ছিল বিমুদ্রাকরণের ফলে করদাতার সংখ্যা প্রচুর বাড়বে এবং তাতে আয়কর আদায় অনেক বাড়বে। তথ্য বলছে, আয়কর দাতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে কিন্তু এঁরা বেশির ভাগই হয় করযোগ্য নন নয়তো অল্প করের বন্ধনীতে পড়েন। ফলে, এই সূত্রে আয়কর সংগ্রহ নাটকীয় সে রকম বাড়েনি। যেহেতু, কর্পোরেট ক্ষেত্র জিএসটির ফলে (এবং বিমুদ্রাকরণের ফলেও কিছুটা বটে) চাপের মধ্যে রয়েছে অতএব কর্পোরেট করে বোঝা কমানোর দাবি এখনই বেশ জোরালো। বিভিন্ন চেম্বার অব কমার্সের অনুমাণ, কর্পোরেট করের বোঝা কমলেও কর আদায় বাড়বে যেহেতু কর ফাঁকির প্রবণতা কমবে। এর মধ্যে দাবি উঠেছে সম্পদ কর ফিরিয়ে আনার, যা তুলে দেওয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। তৃতীয় ক্ষেত্র হল বিলগ্নীকরণ কর। গত বাজেটে লক্ষ্য ছিল ৭২,৫০০ কোটি টাকা, যা অক্টোবর মাস অবধি আদায় হয়েছে ৩০,১৬৫ কোটি টাকা।
এমতাবস্থায় সরকার যা ধার করার কথা ভেবেছিলেন ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭-র মধ্যে তার ৯০ শতাংশই নেওয়া হয়ে গিয়েছে। সরকার এই ধার নেওয়ার লাগাম টানার কথা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু, সরকারের হাতে বাজেট বইতে প্রত্যক্ষ করের হার পুর্ণবিন্যাস ছাড়া করের ব্যাপারে অন্য কিছু প্রকাশ করার এক্তিয়ার নেই। এই মুহূর্তে ব্যক্তিগত করের হারে খুব নাটকীয় পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম, যেহেতু কর্পোরেট করের হার কমানোর সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং, মধ্যবিত্ত করদাতারা খুব বেশি সুখবর আশা না-ই করতে পারেন।
গত বছর, ‘নোটবন্দি’ সত্ত্বেও সরকারের ভাগ্য এক দিক দিয়ে সুপ্রসন্ন ছিল, কারণ মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল বেশ কম। গত বছর জানুয়ারি মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার (ভোগ্যপণ্যের) যেখানে ২ শতাংশের কম ছিল, সেখানে এ বছর সেই হার ৫ শতাংশেরও বেশি। তার মধ্যে, খাদ্যদ্রব্যের ও পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষকে যথেষ্ট বিপাকে ফেলেছে। এমতাবস্থায় সরকার জিএসটি হার কমিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। যদিও তা আবার কর আদায়কে কমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
একটা জিনিস পরিষ্কার— সরকার যদি অর্থনীতির উন্নয়নের রথের গতি ত্বরাণ্বিত না করতে পারেন তা হলে কোনও কুলই রাখা মুশকিল। তার উপর ২০১৯-এ আসছে লোকসভা নির্বাচন। এমতাবস্থায় কৃষিক্ষেত্রের উপর বিশেষ নজর দেওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ কৃষির উৎপাদন এবং বণ্টন যদি জোরদার হয়, তবে সাধারণের কৃষিজাত ভোগ্যপণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা যথেষ্ট। কিন্তু সরকার সরাসরি এ ব্যাপারে খুব বেশি কিছু না করতে পারলেও কৃষি পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ বেশি করে বাড়াতে পারেন—বিশেষত ক্ষুদ্র সেচ, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং কোল্ড স্টোরের ব্যাপারে। কিন্তু, গত বাজেটে সরকার মূলধন খাতে যা খরচ করবে ঠিক করেছিল, তার মোটামুটি ৫২ শতাংশ খরচ হয়েছে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। আর সেই সময়ে মাইনে, ভর্তুকি আর পেনশন বাবদ বাজেটের ৬২ শতাংশের উপরে খরচ হয়েছে। সুতরাং, ইচ্ছা থাকলেও সরকারের খরচ কৃষির পরিকাঠামো উন্নয়নে কত হবে বলা শক্ত।
কিন্তু, ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, যার উন্নতি সবচেয়ে বেশি চাকুরী সৃষ্টি করতে পারে, তার এপ্রিল থেকে অক্টোবর, ২০১৭ পর্যন্ত উন্নতির হার মোট ২.১ শতাংশ। যা ২০১৬-তে একই সময়ে ছিল ৫.৯ শতাংশ। অতএব এর মহৌষধি হল বেশি করে চাহিদা বৃদ্ধি। অতএব আবার জিএসটি এবং কর্পোরেট কর কমিয়ে অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা যা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু, গত বছরের বাজেটে ‘নোটবন্দি’ র প্রভাব কাটানোর জন্যে সরকার বেশ কিছু ছাড় ঘোষণা করেছিলেন, বিশেষত গাড়ি এবং বাড়ির ঋণের ক্ষেত্রে। এই বাজেটে এর উপর নতুন কিছু করার সম্ভাবনা ক্ষীণ— ছোটখাট সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা হতেই পারে।
যদি চাহিদা সৃষ্ট হয় তবে জোগান ঠিক রাখার জন্যে সস্তায় ঋণ দরকার। ব্যাঙ্কগুলি (প্রধাণত সরকারি) অনুৎপাদিত ঋণ সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। সরকার ২০১৯-এর মধ্যে ৭০,০০০ কোটি টাকার মূলধন জোগানের কথা ব্যাঙ্কগুলিকে বলেছিলেন তিন বছর আগে। কিন্তু, এর প্রয়োজনীয়তা আরও অনেক। বাজেটে এই বিষয়ে কিছু বক্তব্য থাকতে পারে, কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার সারা বছরে বিভিন্ন সময়ে ব্যবস্থা ঘোষণা করেন— এতএব খুব নতুন কথা নাও আসতে পারে।
অনেকেরই ধারণা, আসছে বছর নির্বাচন, অতএব বাজেটে এর প্রতিফলন ঘটবে। কিন্তু, সবারই মনে রাখা দরকার বাজেটের পরিসর বিভিন্ন কারণে সঙ্কুচিত হয়েছে। অন্যান্য বেশির ভাগ দেশেই বাজেটকে সরকারের বার্ষিক আয় ব্যয়ের প্রতিবেদন বলে দেখা হয়। আমাদের এখানে পরিকল্পনার যুগে বাজেটের যে নীতি নির্ধারণে গুরুত্ব ছিল, বর্তমান কালে তা যে অনেকাংশে স্তিমিত সেটা ভাবনায় রাখা জরুরি।