ট্যাব বন্দি বাজেট। ব্যাগে সেটি নিয়ে সংসদের পথে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। সোমবার নয়াদিল্লিতে। রয়টার্স
কোভিড-বছরে দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি রাজকোষেরও যে বেহাল দশা, সেই সত্যি অন্তত বাজেটে লুকোলেন না। কিন্তু তেমনই অতিমারি আর লকডাউনের জোড়া আক্রমণে মন্দাগ্রস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উপযুক্ত ‘অভূতপূর্ব’ কোনও দাওয়াইয়েরও দেখা মিলল না অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বাজেটে।
নির্মলা কথা দিয়েছিলেন, এ বছর ‘অভূতপূর্ব’ বাজেট পেশ করবেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, কোভিড ও লকডাউনের পরে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দাওয়াই প্রয়োগ শুরু হয়েছিল ‘আত্মনির্ভর প্যাকেজে’। তাকে ‘মিনি বাজেট’ তকমা দিয়ে তাঁর দাবি ছিল, সেই ধারা বজায় রেখেই বাজেট পেশ করা হবে। সোমবার সংসদে বাজেট পেশের পরে দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রীর কথাই ঠিক। কারণ, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে পরিকাঠামোয় ‘রেকর্ড’ খরচের কথা ঘোষণা হল। কিন্তু বাস্তবে সরকারি খরচ বিশেষ বাড়ল না। বায়োকনের কর্ণধার কিরণ মজুমদার শ-এর কথায়, ‘‘বাজেটে ঠিক দিশা রয়েছে। কিন্তু এতে কাজ হবে কি না, তা নির্ভর করবে কার্যকর করার উপরে।’’
অর্থনীতিবিদদের একাংশের প্রশ্ন, নির্মলার বাজেটে জাদুদণ্ডের কারসাজি নেই। সংখ্যা স্বচ্ছ। কিন্তু অর্থনীতি এই জিয়নকাঠিতে জেগে উঠবে কি? চাহিদা বাড়াতে অর্থমন্ত্রী বাজেটে গরিব-নিম্নবিত্তদের হাতে টাকা তুলে দেননি। মধ্যবিত্ত, চাকুরিজীবীকে আয়করে সুরাহা দেওয়ার পথেও হাঁটেননি। তাঁর আশা, পরিকাঠামোয় খরচের ফলেই বাজারে চাহিদা তৈরি হবে। তৈরি হবে কাজের সুযোগ। লকডাউনে রুজিরুটি হারানো মানুষের অনেকে কাজ ফিরে পাবেন। অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম অবশ্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘বেসরকারি লগ্নি আর বাজারে কেনাকাটার অভাব পূরণ করতে সরকারি খরচ বিপুল পরিমাণে বাড়বে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে সরকারি খরচ ৩৪.৫০ লক্ষ কোটি টাকা থেকে সামান্য বেড়ে ৩৪.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা হয়েছে।’’ অনেকে বলছেন, সরকার এই টানাটানির সংসারেও সকলের উপরে কোভিড-সেস বসায়নি ভাল কথা। ধনকুবেরদের উপরে করের বোঝা সামান্য বাড়িয়ে গরিব-মধ্যবিত্তদের কিছু সুরাহা দেওয়া যেত না?
নির্মলার আশা, তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও সংস্থার বেসরকারিকরণের ঘোষণা করেছেন। শিল্পপতিরা সেখানে বিপুল লগ্নি করবেন। বিমা ক্ষেত্রে তিনি ৭৪% পর্যন্ত বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে দিয়েছেন। কৃষি ক্ষেত্র ও শ্রম আইনের সংস্কার হয়েছে। তার ফলেও বেসরকারি লগ্নি আসার সম্ভাবনা। এই অনুমানে ভর করেই আগামী বছর রাজস্ব আয় যথেষ্ট বাড়বে বলে নির্মলার আশা। তার দৌলতে তিনি মনে করেছেন, এ বছরের মাত্রাছাড়া রাজকোষ ঘাটতি (জিডিপির ৯.৫%) তিনি আগামী অর্থবর্ষে অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারবেন (৬.৮%)। কিন্তু প্রশ্ন, সেই আশা পূরণ হবে তো?
নির্মলার কথায়, ‘‘অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে সরকার তৈরি। এই বাজেট অর্থনীতিতে গতি আনতে ও দীর্ঘস্থায়ী বৃদ্ধির জন্য সব সুযোগ তৈরি করবে।’’
কোভিড মোকাবিলায় বাড়তি খরচ এবং লকডাউনের ধাক্কায় রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি ৩.৫ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেড়ে ৯.৫ শতাংশে পৌঁছেছে। তা লুকোনোর চেষ্টা করেননি অর্থমন্ত্রী। অতীতে ঘাটতি কম দেখাতে খাদ্য ভর্তুকির একটি অংশ খাদ্য নিগমের ঋণ হিসেবে দেখানো হত। কিন্তু এ বার তা-ও বাজেটে জুড়ে নিয়েছেন নির্মলা। হিসেবের কারচুপি করেননি। বাহবা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য রথীন রায়ের মন্তব্য, ‘‘বহুদিন পরে স্বচ্ছ বাজেট।’’
কিন্তু ঘাটতি বাড়লেও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দাওয়াই মিলেছে কি? মোদী সরকারের বাজেটে এত দিন বড় মাপের কোনও আর্থিক নীতির ঘোষণা হয়নি। এই বাজেটেও নেই। একমাত্র নতুন সংস্কার— বিমা ক্ষেত্রে ৭৪% পর্যন্ত বিদেশি লগ্নির অনুমতি। ‘বিলগ্নিকরণ’ নামক লুকোছাপা থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের ঘোষণা। যে তালিকায় দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থাও থাকবে।
কোভিডগ্রস্ত অর্থনীতিকে উদ্ধারে চার দফায় ‘আত্মনির্ভর ভারত প্যাকেজ’ ঘোষিত হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ওই দাওয়াইয়ের বহর জিডিপি-র ১৩%। সমালোচকরা বলেছিলেন, সেই দাওয়াইয়ে সরকারি খরচ খুব কম। বেশির ভাগই সস্তা ঋণ। বাজেটের হিসেবও তা-ই বলছে। কিন্তু গত অর্থবর্ষে ঘাটতি ছিল ৪.৬%। চলতি বছরে তা বেড়ে ৯.৫% হয়েছে। অর্থাৎ, রাজকোষ থেকে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার দাওয়াই বা ‘উৎসাহ প্রকল্প’-এর বহর ৪.৯ শতাংশ বিন্দু।
নতুন অর্থবর্ষে মন্দাগ্রস্ত অর্থনীতিকে জাগাতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, পরিকাঠামোয় তিনি বিপুল পরিমাণ খরচ করবেন। ৫.৫৪ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের তুলনায় পরিকাঠামোয় খরচ বাড়ছে মাত্র ১.১৫ লক্ষ কোটি। অন্য দিকে, রাজস্ব খাতে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা খরচ কমিয়েছেন। কেন্দ্রীয় প্রকল্প-সহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রায় ৩.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা খরচ কমিয়েছেন। রান্নার গ্যাস, সার, খাদ্যে ভর্তুকি কমিয়েছেন। লকডাউনের পরে বিনামূল্যে বাড়তি চাল-গম বিলিতে যে খরচ হয়েছিল, সেই বিলি বন্ধ হওয়ায় তা এমনিতেই কমে গিয়েছে। লকডাউনে গ্রামে ফেরা মানুষের ভরসা একশো দিনের কাজ, কৃষকদের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার জন্য পিএম কিসান প্রকল্পেও বরাদ্দ ছাঁটাই করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা পৌঁছনো উচিত ছিল। তাতে বাজারে চাহিদা হত। আমি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলাম। জানি না তিনি বুঝেছেন কি না। তিনি যা করতে চেয়েছেন, তাতে কাজ হবে না।’’
চলতি বছরে জিডিপি প্রায় ৭.৭% সঙ্কুচিত হবে বলে আশঙ্কা। সেই তলানি থেকে মোদী সরকার নতুন বছরে ১০-১০.৫ শতাংশ বৃদ্ধির আশা করছে। মূল্যবৃদ্ধি-সহ জিডিপি ১৪.৫% বাড়বে অনুমান করে বাজেটের অঙ্ক কষেছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর আশা, কর্পোরেট কর, আয়কর ও জিএসটি আদায় প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকা বাড়বে। অর্থনীতিবিদ প্রসেনজিৎ বসুর বক্তব্য, ‘‘খরচ তেমন না বাড়িয়ে আর্থিক দাওয়াই আগেভাগে প্রত্যাহার করে নিয়েও সরকার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছে। সবটাই বেসরকারি লগ্নির ভরসায়।’’
এ দিন বাজেটের পরে শেয়ার বাজার তেজি হয়েছে। বস্তুত, অর্থনীতিতে মন্দা চললেও, বাজার চাঙ্গাই ছিল। কিন্তু তার সুযোগ নিয়ে মোদী সরকার বিলগ্নিকরণে খুব বেশি এগোতে পারেনি। এ বার বেলাগাম রাজকোষ ঘাটতিকে নামিয়ে আনতে অর্থমন্ত্রীর প্রধান ভরসা বেসরকারিকরণ। নির্মলার আশা, কোভিড-বছরে বেসরকারিকরণ থেকে টাকা তোলার লক্ষ্য পূরণ না-হলেও, নতুন বছরে এয়ার ইন্ডিয়া, ভারত পেট্রোলিয়াম, দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, একটি বিমা সংস্থা বেচে তা সম্ভব হবে। ঠিক যেমন অনেকে মনে করছেন, মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারতের’ স্বপ্ন পূরণের তাগিদেই রক্ষণশীল নীতিতে আমদানি শুল্ক বেড়েছে বহু পণ্যে।
এই আশাটুকুই নির্মলার ভরসা।