বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর সাধ্য যে আপ-এর নেই, তা দ্বিতীয় দফার ভোটে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ফাইল চিত্র।
গোটা দিনের জন্য আমাকে শহর ঘুরিয়ে দেখাবেন শাহরুখ খান!
হোটেলের উল্টোদিকের অটো স্ট্যান্ড থেকে পুরনো আমদাবাদের সাড়ে তিনশো বছরের শাহ-ই-আলম দরগা চত্বর— সর্বত্র এই নামেই পরিচিত এই বর্ণহিন্দু গিরিশ পাঠক। দেখে বোঝা যায় না, বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই। শ্যামবর্ণ মুখের হাসিতে টোল-সমেত শাহরুখের আদল। সেই থেকেই এই নাম।
সকাল সকাল নিজের ভোট সেরে বাহন নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। “বাবা আইআইএম-এর দফতরে করণিকের কাজ করতেন। মিথ্যে বলব না, আমাকে লেখাপড়া শেখানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওই সিনেমা হলেই স্কুল জীবন শেষ।” গাড়ি চালাতে চালাতে সামনের দিকে চোখ রেখে বলে চলেছেন ‘শাহরুখ’।
আমদাবাদ জুড়ে মোট ষোলটি বিধানসভা কেন্দ্র। “তেলের দাম বেড়ে এমন জায়গায় এসেছে, আমাদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। কতদিন গাড়ি বের করতে পারব জানি না। পড়তায় পোষায় না। আমার ভাই কাজ করত একটা হোটেলে। মাঝে কোভিডে দু’বছর বাড়ি বসে সপরিবার। ওদেরও টানতে হয়েছে। ভোট তো দিয়েছি, কিন্তু জানি না হাল শুধরোবে কি না।”
কথা বলতে বলতেই অটো ঢুকেছে এলিজ ব্রিজ পেরিয়ে পুরনো আমদাবাদে। এক একটা জায়গা পুরনো দিল্লির থেকেও ঘিঞ্জি— সুর্মা, আতর আর কাবাবের মিশ্র গন্ধময়। গ্লোসাইনে ঝলমল করছে তন্দুরি আর টিক্কার স্টল। ‘হাল হামজা’ নামের একটা পুরনো, পেল্লাই রেস্তোরাঁর সামনে অটো দাঁড় করালো শাহরুখ। “রাত বারোটা পর্যন্ত এই দোকানে টাটকা খাবার পাবেন। কখনও কোনওদিন গোলমাল হয় না এই দরগা চত্বরে।”
আল হামজা-র মালিক তনভির মালিক যুবক। সদ্য বাবার হাত থেকে দায়িত্ব নিয়েছেন। বললেন, “এখানে কোনও দিন কোনও অশান্তি হয়েছে— এমন কথা মনে পড়ে না। আগের কথা জানি না, তবে এখন এখানকার মানুষ যেটা সবচেয়ে বেশি চায়, সেটা হল শান্তিতে ব্যবসা করার সুযোগ। কিন্তু সমস্যা হল, গত কয়েক মাসে জিনিসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে। কোভিডের ধাক্কা সামলানোটাও বড় ব্যাপার’’ স্থানীয় পুরকর্তা কংগ্রেসের সাজ্জাদ খান এখানে দেবতুল্য সম্মান পান। কারণ, ‘‘সমস্যায় একবার ডাকলেই তিনি হাজির। খোলা ড্রেন ঢেকে দেওয়া হোক কিংবা জলের সমস্যা— সমাধান করার চেষ্টা করেন। রাতবিরেতে আমরা দোকান বন্ধ করি, কিন্তু গত পাঁচ বছরে একদিনের জন্যও চুরি ছিনতাইয়ের কোনও ঘটনা ঘটেনি।”
চুরি ছিনতাই নেই। এই প্রাচীন দরগাকেন্দ্রিক বিধানসভা কেন্দ্রে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কথাও মনে করতে পারছেন না এলাকার মানুষজন। কিন্তু যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে আছে তা-ও তো কম নয়। সঞ্জারি জুয়েলার্স-এ বসে কথা বলছিলাম দোকানের মালিক মেহমান আব্দুল রেজ্জার সঙ্গে। বছর সত্তর বয়স। রুপোর গয়নার ছোট্ট দোকানটির মালিকের সাদা পোশাক, মাথার টুপিটিও শুভ্র। সাদা নাড়িয়ে আক্ষেপের সঙ্গে বলছিলেন, “আর সব ছাড়ুন, রোজকার খাবার জোগাড় করাটাই দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে। আজ থেকে এক বছর পর আধপেটা খেয়ে থাকতে হবে কিনা, তা-ই বা কে জানে? পাঁচ বছরে সরকারি স্কুল লাটে উঠেছে, বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর এতই খরচ যে কারও একাধিক সন্তান থাকলে টিউশন ফি দেওয়াই কষ্টকর। ওষুধ কিনতে গেলে দু’বার ভাবতে হয়, এত দাম বেড়েছে।”
কথাবার্তার মধ্যেই একটি অতি সুভব্য চেহারার যুবক (পোশাক কিছুটা পুরনো কিন্তু মলিন নয় আদৌ) দোকানে ঢুকে গুজরাতিতে রেজ্জার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। মিনিট কুড়ি বসে রয়েছি, দোকানে কোনও ক্রেতার দর্শন পাইনি। সম্ভাব্য ক্রেতা ভেবে এবং কিছু কথা বলব ভেবে হিন্দিতে পরিচয় দিয়ে তাঁর সঙ্গে করমর্দন করলাম। তিনিও করলেন। তারপর অন্য কথায় না গিয়ে সোজা টাকা চাইলেন অত্যন্ত মার্জিত ভাবে! বোঝাই যাচ্ছে যুবকটি শিক্ষিত। তবে তাঁর কথা শুনে হতভম্ব ভাবটা কাটতে না কাটতে একটু চড়া সুরেই রেজ্জাসাহেব তাঁকে বিদায় করলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, “দেখুন, এই তো হাল হয়েছে শহরের। কিছুক্ষণ থাকলে এ রকম অনেক দেখতে পাবেন। ভদ্রঘরের লেখাপড়া জানা সব ছেলেপুলে। আর একে তো আমি চিনিই। টুলু পাম্পের দোকানে খাতা লেখার চাকরি করত, তারপর এটা সেটা। এখন কিছুই নেই, স্রেফ ভিক্ষা। কয়েকদিন দিয়েছি, এখন বলে দিয়েছি সম্ভব নয়। আমারই হাল খারাপ, দেবো কোথা থেকে?”
এই পরিস্থিতিতে কি পরিবর্তন চাইছে না আমদাবাদ? চাইছে তো বটেই। কিন্তু চাইলেই কতটা সম্ভব হবে— তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কংগ্রেসের বড় নেতাদের দেখা মেলেনি। আপ এখানে এসে ৩০০ ইউনিট বিদ্যুৎ বিনামূল্যে দেওয়ার ঘোষণা করায় অনেকেই কেজরীওয়ালকে মন থেকে বিশ্বাস করতে চাইছেন। কিন্তু এবারও বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর সাধ্য যে আপ-এর নেই, তা দ্বিতীয় দফার ভোটে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।