এই সেই ছেলে দ্রব্য ঢোলাকিয়া।
হিরে ব্যবসায়ী কোটিপতি বাবা তাঁর একমাত্র ছেলেকে পাঠালেন ‘বনবাসে’!
দেখে শিখতে, ঠেকে শিখতে। ঘাম ঝরিয়ে রোজগারের রাস্তা খুঁজতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলদঘর্ম হয়ে রোজগার করতে।
বাবার ছ’হাজার কোটি টাকার কোম্পানি। হিরে ব্যবসায়ী। তাঁর কোম্পানির ব্যবসা রয়েছে বিশ্বের ৭১টি দেশে। আর তাঁর কেতাদুরস্ত, ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ছেলে এমবিএ পড়ছে মার্কিন মুলুকে। মাসকয়েকের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিল। মা তো খুব খুশি, অত দিন পর ছেলেকে হাতে পেয়ে।
কিন্তুর বাবার সে সব পছন্দ হল না। ছেলের জন্ম হয়েছে রূপোর চামচ মুখে নিয়ে। জন্মেই জেনে গিয়েছে, তার খাওয়া-পরার কোনও সমস্যাই নেই। তাদের ‘হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া’ আছে। তাই তার না খাটলেও চলবে। না চাইতেই সে পেয়ে যাবে সব কিছু। এটা তো ঠিক নয়! ছেলের মাথা ঘুরে যাবে যে!
আর শুধু শুধু তো তিনি ছেলেকে এমবিএ পড়তে পাঠাননি আমেরিকায়, কয়েক লক্ষ ডলার খরচ করে। ভাবনাটা তো মাথায় রয়েছেই একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। দেশে দেশে ছড়ানো তাঁর ওই বিপুল ব্যবসাটার দেখভাল করবে কে? যাঁর হাতে দিয়ে যাবেন তাঁর ‘সাম্রাজ্য’ চালানোর ভার, তাকে একটু পরীক্ষা করে দেখে নিতে হবে না! বুঝে নিতে হবে না, ব্যবসাটাকে ঠিকঠাক ভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাঁধটা শক্তপোক্ত হয়েছে কি না ছেলের!
তাই আমেরিকা থেকে কেতাদুরস্ত ছেলে ঘরে ফিরতেই বাবা তাঁর ২১ বছরের ছেলে দ্রব্য ঢোলাকিয়ার হাতে ধরিয়ে দিলেন হাজার সাতেক টাকা আর তিন জোড়া প্যান্ট-শার্ট। দিয়ে ছেলেকে বললেন, ‘‘যাও, কোচিতে চলে যাও। গিয়ে সুস্থ ভাবে, খেটেখুটে রোজগার করার জন্য একটা কাজ জুটিয়ে নাও সেখানে। থাকো মাসখানেক বা তার চেয়ে একটু বেশি। দরকার না পড়লে ওই সাত হাজার টাকায় হাত দিও না।’’
দ্রব্যর বাবা হিরে রফতানি সংস্থা ‘হরে কৃষ্ণ ডায়মন্ড এক্সপোর্টস’-এর মালিক সবজি ঢোলাকিয়া বলছেন, ‘‘আমি কয়েকটা শর্ত দিয়েছিলাম আমার ছেলেকে। তাঁকে সুস্থ ভাবে রোজগার করার জন্য তড়িঘড়ি একটা কাজ জোগাড় করতে বলেছিলাম। বলেছিলাম, কাজের জন্য যেন কোনও একটি জায়গায় সে এক সপ্তাহের বেশি না থাকে। যেতে হবে তাকে এমন একটা জায়গায়, যেখানে সে যায়নি কোনও দিন, কাউকে চেনে না। এমনকী, জানে না সেখানকার ভাষাটাও। কাজ জোগাড় করার জন্য বাবার পরিচয় যেন সে কোথাও না ব্যবহার করে। মোবাইল ফোনও যেন ব্যবহার না করে। আর কোচিতে যাওয়ার আগে বাড়ি থেকে এক মাসের জন্য তাকে যে হাজার সাতেক টাকা দেওয়া হয়েছিল, খুব বিপদে না পড়লে যেন তাতে একটুও হাত না দেয় ছেলে। আমি চেয়েছি, ছেলে বুঝুক, এ দেশে গরিব মানুষ কী ভাবে জুতোর সুকতলা খুইয়ে একটা কাজ জোগাড় করে। কী ভাবে সামান্য কয়েকটা টাকা রোজগার করতে তাদের দিবারাত্র ঘাম ঝরাতে হয়। এটা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষ লক্ষ বই পড়ে জানা যায় না। বোঝা সম্ভব নয়।’’
হিরে ব্যবসায়ীর এই ছেলেকে ‘বনবাসে’ পাঠানোর ঘটনাটা কি নিছকই লোকদেখানো? যেমন গরিবের কথা আকছারই আওড়াতে দেখা যায় রাজনীতিকদের!
সম্ভবত নয়। কারণ, ওই হিরে ব্যবসায়ী সবজি ঢোলাকিয়াই তাঁর কোম্পানির কর্মচারীদের গত বছর বোনাস হিসেবে গাড়ি আর ফ্ল্যাট দিয়ে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন!
বাবার ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জটা লুফে নিয়েছিলেন দ্রব্য। তাঁর কথায়, ‘‘বাবা বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। কোচি জায়গাটাকে বেছে নিয়েছিলাম, আমার একেবারেই অচেনা, অদেখা বলে। আর সেখানকার মালয়ালি ভাষাটাও আমি একদমই জানতাম না। যেটা জানি, সেই হিন্দি বললে ওই মুলুকে কেউ বুঝতে পারেন না এক বিন্দুও।’’
কিন্তু নানা রকমের চমক যে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল কোচিতে, তার বিন্দু-বিসর্গও জানতেন না দ্রব্য।
দ্রব্যের কথায়, ‘‘কোচিতে যাওয়ার পর টানা পাঁচ দিন কোথাও কোনও কাজ জোগাড় করতে পারিনি। থাকার জায়গাও জোটাতে পারিনি কোথাও। কাজের জন্য কম করে ৬০টি জায়গা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। তাঁরা কেউই আমাকে চাকরি দিতে চাননি, চেনেন না বলে। কাকে বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া, আর অচেনা মুলুকে গিয়ে কাজ জোটাতে না পারলে কী দশা হয়, তা আমি ওই পাঁচ দিনেই হাড়েহাড়ে টের পেয়ে গিয়েছিলাম। ঢের মিথ্যেও বলেছি কাজ খুঁজতে গিয়ে। বলেছি, বারো ক্লাসের বেশি বিদ্যেবুদ্ধি নেই আমার। গুজরাতে খুবই গরিব ঘর থেকে আসা ছেলে আমি। পাঁচ দিন পর প্রথম কাজটা পেয়েছিলাম আমি চেরানেল্লুরে, একটি পাউরুটি কারখানায়। তার পর একটা কল সেন্টারে কাজ পাই। সেখান থেকে কাজ জোটাই একটা জুতোর দোকানে। এই করতে করতে তিরুঅনন্তপুরমে, কেতাদুরস্ত ‘ম্যাকডোনাল্ডস’-এর দোকানেও একটা কাজ জোটাতে পেরেছিলাম। সেখানে মাসে ৪ হাজার টাকা বেশি পেতাম। তবে ওইখানেই প্রথম বুঝতে পারি, বেশি রোজগার করাটা কতটা জরুরি। সামান্য ব্রেকফাস্ট করতেই বেরিয়ে গিয়েছিল ৪০ টাকা। পরে থাকার জন্য খুব সস্তার একটা লজেও ঘর-ভাড়া গুনতে হল ২৫০ টাকা।’’
বাবার নেওয়া ‘পরীক্ষা’য় একেবারে ‘লেটার মার্কস’ পেয়ে পাশ করেছে দ্রব্য। ঘরে ফিরেছে দিনদু’য়েক হল।
আর তাঁর শিল্পপতি বাবা যেটা চেয়েছিলেন, সেটাই হয়েছে।
‘দ্রব্যার্থে’র আদত অর্থটা হাড়েহাড়ে পুরোপুরি বুঝে গিয়েছে দ্রব্য, জীবন যাকে দেখিয়ে আর ঠেকিয়ে শিখিয়েছে, হাতে-কলমে! যাতে চলার পথে না ঠকতে হয় তাঁকে!
আরও পড়ুন- তিন সাংবাদিককে দেশে ফেরত পাঠানোর পরিণতি মারাত্মক, হুমকি চিনের