তেজস্বী যাদব এবং নীতীশ কুমার। পিটিআই
বিহারে সরকার গড়ার দৌড়ে আরজেডি-কংগ্রেস-বামেদের মহাগঠবন্ধনকে এগিয়ে রাখল প্রায় সব বুথ-ফেরত সমীক্ষা। আজ, তৃতীয় তথা শেষ দফার ভোট শেষ হতেই বুথফেরত সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হতে শুরু করে। দেখা যায় সব সমীক্ষাতেই এগিয়ে রয়েছে তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বাধীন জোট। যদিও রাজ্যের শাসক জোট এনডিএ-র দাবি, মঙ্গলবার গণনা শুরু হলেই ছবিটা পাল্টে যাবে।
এটা ঠিক যে, অতীতে অনেক বারই বুথ-ফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস শেষ পর্যন্ত মেলেনি। আবার সমীক্ষা প্রায় হুবহু মিলে যাওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। সব মিলিয়ে জনমত কোন দিকে ঝুঁকে তার হদিস পেতে এই ধরনের সমীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা মোটের উপরে স্বীকৃত।
করোনা অতিমারি, দেশব্যাপী লকডাউনের পরে বিহারেই প্রথম বিধানসভা নির্বাচন। ফলে এই ভোট এক দিকে যেমন নীতীশ কুমারের গত পাঁচ বছরের রাজ্য শাসনের পরীক্ষা, তেমনই করোনা নিয়ন্ত্রণে নরেন্দ্র মোদী সরকারের ভূমিকাকে আমজনতা কী চোখে দেখছেন, পরীক্ষা তারও। সমীক্ষার পূর্বাভাস ঠিক হলে নীতীশ-মোদী কেউই পাশ করছেন না। অধিকাংশ সমীক্ষাই বলছে, দুই শরিকের মধ্যে বিজেপির আসন কিছুটা বাড়লেও ব্যাপক পরিমাণে জমি হারাচ্ছে নীতীশের দলজেডিইউ। ২০১৫ সালে লালুপ্রসাদের আরজেডি এবং কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়ে জেডিইউ ৭১টি আসন পেয়েছিল। বছরখানেকের মধ্যেই জোট ছেড়ে বিজেপির হাত ধরে তারা। এবিপি নিউজ-সি ভোটারের করা বুথ-ফেরত সমীক্ষার মতে, এ বার তাদের আসন সংখ্যা হতে পারে ৩৮ থেকে ৪৬। বিজেপি পেতে পারে ৬৬ থেকে ৭৪টি আসন। গত বার যা ছিল ৫৪। সব দল মিলিয়ে এনডিএ-র আসন সংখ্যা ১০৪ থেকে ১২৮-এর মধ্যে থাকবে বলে এই বুথ-ফেরত সমীক্ষার অভিমত। ২৪৩টি আসনের বিহার বিধানসভায় ক্ষমতা দখল করতে গেলে ১২২টি আসন জিততে হবে। এনডিএ-র আসন সংখ্যা যদি ১০৪-এ আটকে যায়, তা হলে নীতীশের চতুর্থ বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন হয়তো অধরাই থেকে যাবে।
আরও পড়ুন: ফিরছেন না নীতীশ, হুঙ্কার চিরাগদের
এনডিএ-র তুলনায় বিরোধীদের মহাগঠবন্ধনকে খানিকটা এগিয়ে রেখেছে এবিপি নিউজ-সি ভোটার-এর সমীক্ষা। তাদের মতে, বিরোধী জোট ১০৮ থেকে ১৩১টি আসন পেতে পারে। আরজেডির আসন সংখ্যা হতে পারে ৮১ থেকে ৮৯। গত বার তারা পেয়েছিল ৮০টি আসন। কংগ্রেস পেতে পারে ২১ থেকে ২৯টি আসন এবং বামেরা ৬ থেকে ১৩টি।
রিপাবলিক টিভি-জন কি বাত-এর সমীক্ষা অনুযায়ী এনডিএ-র আসন থাকতে পারে ৯১- ১১৭-এর মধ্যে। মহাগঠবন্ধন পেতে পারে ১১৮-১৩৮টি আসন। কিন্তু টুডেজ় চাণক্যের সমীক্ষা অনুযায়ী, মহাগঠবন্ধন প্রায় ৪৪ শতাংশ ভোট পেতে চলেছে। সেটা সত্যি হলে, তেজস্বীর পক্ষে কার্যত ঝড় উঠতে চলেছে। ওই সংস্থার মতে, মহাজোট জিততে পারে প্রায় ১৮০টি আসন। আর এনডিএ নেমে আসবে ৫৫-তে।
তবে প্রথম দু’টি সমীক্ষার ফল ঠিক হলে দু’শিবিরের মধ্যে সংখ্যার পার্থক্য সেই অর্থে বেশি হবে না। এনডিএ-র নেতাদের আশা, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলেও শেষ হাসি তাঁরাই হাসবেন। অন্য দিকে আশায় বুক বেঁধেছে মহাগঠবন্ধনও। তাঁদের নেতারা মনে করাচ্ছেন, ২০১৪ সালে মোদী কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরে একমাত্র উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাত ছাড়া আর কোনও রাজ্যে সরাসরি জিততে পারেনি এনডিএ। কিন্তু দু’শিবিরের সংখ্যার ফারাক যদি সামান্য হয়, তা হলে কি হরিয়ানা বা মধ্যপ্রদেশের ছবির পুনরাবৃত্তি হবে? অর্থাৎ, বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গড়ার পথে হাঁটবে বিজেপি। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না রাজনৈতিক মহল।
আরও পড়ুন: উপনির্বাচনে এগিয়ে বিজেপি, বলছে সমীক্ষা
এ বারের ভোটে অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন এলজেপি নেতা চিরাগ পাসোয়ান। ভোটের ঠিক আগে এনডিএ থেকে বেরিয়ে এসে একলা লড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যদিও অনেকের মতে, নীতীশ-বিরোধী ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিয়ে মহাগঠবন্ধনের যাত্রাভঙ্গ করতে চিরাগকে খাড়া করেছিল বিজেপি-ই। সব মিলিয়ে রাজ্যের ১৩৭টি আসনে প্রার্থী দেওয়া চিরাগের দল অধিকাংশ সমীক্ষায় আসন পেয়েছে দুই থেকে পাঁচটি। সে ক্ষেত্রে চিরাগের তুরুপের তাস হওয়ার সম্ভাবনা কমই।
বুথ-ফেরত সমীক্ষার পূর্বাভাস ঠিক হলে তার কারণ কী, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। অনেকেই বলছেন, গত ১৫ বছর ধরে কার্যত একটানা মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন নীতীশ। ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া কাজ করছে তাঁর বিরুদ্ধে। রয়েছে সরকারের দুর্নীতি, মুখ্যমন্ত্রীর ঔদ্ধত্যের অভিযোগ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থতার অভিযোগও। লকডাউনের সময়ে বহু কষ্টে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের গোড়ার দিকে রাজ্যে ঢুকতে দিতে রাজি ছিলেন না নীতীশ। তা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। তার পরে লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে গা-ছাড়া মনোভাবের অভিযোগও ওঠে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে। ফলে এ বার ভোটের আগে গোটা বিহার জুড়েই ‘নীতীশ হটাও’ ডাক উঠেছিল।
বিরোধীদের দাবি, নীতীশের মতো মোদী সরকারের উপরেও যে মানুষ ক্ষুব্ধ, তা পরিষ্কার। কয়েক বছর ধরেই অসংগঠিত ক্ষেত্রে রোজগার ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় চার ঘণ্টার নোটিসে ডাকা লকডাউন। পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার ভার নীতীশের পাশাপাশি মোদীর উপরেও বর্তায়। পরে বিকল্প রোজগারের দিশা দেখাতেও ব্যর্থ তাঁর সরকার।
বছর ঘুরলেই পশ্চিমবঙ্গে ভোট। বিহারে বুথ-ফেরত সমীক্ষার ফল যদি ঠিক হয়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি কমীদের মনোবল ধাক্কা খাবে বলে মানছেন বিজেপি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তের। তবে তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার প্রভাব কিন্তু তৃণমূল সরকারের উপরেও পড়বে।’’