তপোধীর ভট্টাচার্য
শুরুতেই শিরোনামে ব্যবহৃত ‘অসম’ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট কথা বলি। শৈশব থেকে আমাদের প্রদেশ-নাম আর তার উৎপত্তির ইতিহাস যে ভাবে জেনে এসেছি, হঠাৎই এক দিন তা হাওয়ায় উড়িয়ে দিল প্রাদেশিকতা-বাদী বুদ্ধিজীবীরা। পাল্টে গেল প্রদেশ নাম এবং বিনা বাক্যব্যয়ে তাকে বৈধতা দিল বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সমস্ত সংবাদপত্র। এ সম্পর্কে যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করেন, এই নিবন্ধ-লেখক তাঁদের অন্যতম। কেন, যদি কেউ জানতে চান—হাইলাকান্দির যোদ্ধা-সম্পাদক কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যের যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধ পড়ে দেখুন। যে কথাটা বলবার তা হল, শব্দ-ব্যবহারের পিছনে সক্রিয় রাজনীতির দিকটি আমরা তলিয়ে ভাবিনি কখনও।
এখনও কী ভাবছি? অথচ গোপীনাথ বরদলৈ, বিক্ষুরাম মেধি, অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরীদের সুতোয় বাঁধা পুতুল-রাজ্যপাল হায়দর আলি স্বাধীনতা অর্জনের মুহূর্তেই যে জঘন্য বাঙালি-বিদ্বেষ প্রকাশ করেছিলেন, নাম বদলের তাৎপর্য খুঁজতে হবে সেখানেই। তার পর পর্বে-পর্বান্তরে কংগ্রেস কিংবা অগপ বা অন্য কোনও দলের যে মুখ্যমন্ত্রীই রাজ্যপাট সামলে থাকুন না কেন, বাঙালি মাত্রই বিদেশি, এবং সেই অপরাধে তাদের ‘খেদিবই লাগিব’ নীতিটির কোনও নড়চড় হয়নি। বঙাল-খেদায় গোরেশ্বর একটা প্রতীক, পরবর্তী বিদেশি-খেদায় নেলি ও গোহপুরের হিংস্র গণহত্যা আরও দুটি প্রতীক। ‘বাঙালি মাত্রই বাংলাদেশি’, এই জিগির যেন এই প্রদেশের বিউগল-ধ্বনি। আইএমডিটি বাতিল করার প্রবল উদ্দীপনায় এবং যাকে খুশি তাকেই ‘বিদেশি’ তকমা দিয়ে নোটিস পাঠিয়ে ‘গণতান্ত্রিক সরকার’ আক্রোশই প্রকাশ করেছে শুধু। কিন্তু সব আধিপত্যবাদী সংস্থা একজোট হয়ে দীর্ঘ প্রস্তুতির পর সর্বোচ্চ সংস্থাগুলিতে কর্মরত অসমিয়াভাষী প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাহায্যে চিরশত্রু বাঙালির শ্বাসরোধ করার আয়োজনে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে। এনআরসি অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জিই সেই ব্রহ্মাস্ত্র।
এত দিন যাই হয়ে থাকুক, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতেই সেই সব আস্ফালন সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় চরিত্র আমূল পরিবর্তিত হওয়ার ফলে অসমিয়া সম্প্রসারণবাদ যে সমস্ত দাঁত-নখ বের করে বরাক উপত্যকার ঘরে ঘরে
আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে, গত ৬৭ বছরে তা সম্ভব হয়নি। এক দিকে লিগ্যাসি ডেটা খোঁজার নামে ‘কার্নিভাল’ চলছে, অন্য দিকে খবরের কাগজগুলি রাজনৈতিক ফাঁসুড়েদের ধূর্ত চক্রান্তের মর্ম অনুধাবন না করেই তাদের দ্বারা আরোপিত পুরনো ও নতুন তথ্য ছেপে চলেছে। কেউ গভীরে হাত রাখছে না। যদি রাখতে চাইত, অনেক মঞ্চসাজই ভেঙে যেত। কিন্তু পড়ুয়াদের স্মৃতি বড় দুর্বল। নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে নিজেরাই অজ্ঞ ও অনাগ্রহী। তাই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী বেপরোয়া ভাবে বাঙালির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সাপ-লুডোর চাল দিয়েই চলেছেন। গত কয়েক মাসে খবরের কাগজগুলির শিরোনাম মনে করুন। ঠিক বুঝতে পারবেন—বোকাসোকা বাঙালিদের ধৈর্য অপরিসীম। আর এই হল সমস্ত রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে বড় মূলধন। কিন্তু এ সব কথা তো বহু বার হয়েছে। সম্ভবত সমবেত বুদ্ধিনাশের এই পর্যায়ের মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে আত্মবিস্মৃত বাঙালির সামূহিক স্মৃতিলোপে! তাই মৌলিক ও অনিবার্য কিছু প্রশ্ন তুলে ধরছে না কেউ।
নাগরিক পঞ্জি তৈরির পিছনে প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে আসা বিপন্ন বাঙালিদের হুঁকো-নাপিত বন্ধ করার সর্বাত্মক চক্রান্ত যে আসলে আযাবর্ত-কেন্দ্রিক হিন্দুত্ববাদ ও অসমিয়া সম্প্রসারণ-বাদের যৌথ শিল্পকর্ম, সে দিকে তর্জনি-সঙ্কেত করা হচ্ছে না কেন? দেশভাগের আগে শরৎকুমার বসু, এ কে ফজলুল হক প্রমুখ যে যুক্তবঙ্গ গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন, মহাত্মা গাঁধী-সহ নেহরু-পটেল-জিন্না তাতে কর্ণপাত করেননি কেন? স্বাধীন ভারতে বাঙালিদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার জন্য কী? অন্তরে-বাহিরে অন্ধ পশ্চিমবঙ্গের অদূরদর্শী নেতৃত্ব কি উপ-ভাষাভাষী পূর্ববঙ্গের সঙ্গে সহাবস্থানে রাজি ছিলেন না? তাই খণ্ডিত ভারতে মানচিত্রহীন অসমের বাঙালিদের সম্পর্কে ওই নেতৃত্বের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। সাধ করে তো কেউই সাত পুরুষের ভিটে-সমাজ বা পরম্পরা ছেড়ে নতুন বসতির খোঁজে বেরিয়ে পড়েনি! নেহরু-লিয়াকত বা ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে আসলে কী ছিল? কেন এখন সুকৌশলে খবরের কাগজে ইন্দিরা গাঁধীর নামে উদ্দেশ্য-প্রণোদিত তথ্য ছাপানো হচ্ছে? এত দিন এই সব ‘মিথ্যা সত্য’ উৎপাদন করা হয়নি কেন?
১৮৭৪ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির নিঃশব্দ বঙ্গভেদে কাছাড়-সিলেট-গোয়ালপাড়াকে সরিয়ে নিয়ে অসম প্রদেশ বানানো হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘অজগর সাপের ঐক্যনীতি’ অনুযায়ী গোয়ালপাড়া হল অসমিয়াভূত। সিলেট তার বঙ্গীয় উৎস ভোলেনি। কাছাড়ের উপর আক্রোশভরা আক্রমণ অব্যাহত রইল। ১৯৬১ সালের ১৯ মে এগারো জন ভাষাশহিদ প্রমাণ করেছিল কাছাড় আসলে আধা-ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের শিকার। কী ভেবেছিল আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদ? পুরনো প্রজন্ম বিদায় নিলে কেন্দ্রহীন পরম্পরাহীন নতুন প্রজন্ম ভোগবাদী বিশ্বায়নের বিদূষণ আর আঞ্চলিক প্রভুত্ববাদের সাঁড়াশি আক্রমণে ভুলে যাবে নিজেদের ভাষিক অস্তিত্ব? নাগরিক পঞ্জি যে আতান্তর তৈরি করেছে, সেই ঝামেলা এড়াতে ওরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অসম থেকে পালিয়ে যাবে, নয় তো দো-আঁশলা পরিচয়ে আত্মগোপন করবে?
এই যে কথাগুলি লিখছি, সবই তো মূলত মধ্যবর্গীয়দের সমস্যা। কিন্তু যাঁরা নেহাতই নিরাশ্রয় ও অসহায় নিম্নবর্গীয় হিন্দু-মুসলমান, তাদের ভাগ্যে কি ‘ডি-ভোটার’ আর ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’? কাদের দুঃসহ স্পর্ধায় ‘ভূমিপুত্র’র রাজনীতি দিন দিন ফ্যাসিবাদী চরিত্র অর্জন করছে? হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর কাছে নাড়া বেঁধে কারা বাঙালিদের নব্য-ইহুদি বানাতে চাইছে? দিনের পর দিন বাঙালিত্বের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়ে
হিন্দু-মুসলমান কিংবা কৈবর্ত-ব্রাহ্মণ বা সিলেটি-কাছাড়ি ইত্যাদি বিভাজনকে পাকাপোক্ত করছে কোন রাষ্ট্রযন্ত্র? গণমাধ্যমগুলি ‘নিরপেক্ষতা’ বিসর্জন দিয়ে কেনই বা ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ নীতির প্রবক্তাদের মুখপত্র হয়ে পড়ছে?
কেন বলা হচ্ছে না, আমরা সবাই অবিভক্ত ভারতের সন্ততি? যেখানে শক হুনদল পাঠান মোগল ‘একদেহে লীন’ হয়েছিল? আর যত গোল সিলেটি-বাঙালিদের প্রতি বিদ্বেষে? তা যদি সর্বোচ্চ আদালতের সওয়াল-জবাবেও দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে থাকে—পূর্বসিদ্ধান্তে বহাল থাকা বিচারকের বিচার কি প্রহসনে পরিণত হচ্ছে না? ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭ অবধি যে-সিলেট অবিভক্ত ভারতের অপরিহার্য অংশ ছিল (একই সঙ্গে অসমেরও)—সেই সিলেট-সন্ততিদের ‘বাংলাদেশি’ বা ‘বিদেশি’ অভিধা দেওয়া হচ্ছে কোন নির্লজ্জ কুযুক্তিতে? ভারত জুড়ে যে সংবিধান সর্বমান্য, অসম কী আলাদা রাষ্ট্র, যে তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা? কেন সর্বোচ্চ আদালতে সাংবিধানিক নীতির প্রশ্নে আমরা সুবিচার চাইছি না? যেখানে পক্ষপাতদুষ্ট বিচারকের বদলে নিরপেক্ষ আইন–বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি নিশ্চিত হবে? মানবিকতার কথা না হয় না-ই বা তুললাম!
অবিভক্ত ভারত ও অসমের সন্ততি হিসেবে যারা ভূমিপুত্র, তাদের অবস্থান কেন চা-বাগান শ্রমিক বা অন্য উপজাতিদের তুলনায় স্বতন্ত্র হবে? ইতিহাস-ভূগোল-নৃতত্ত্ব বিষয়ে যাদের কোনও তোয়াক্কা নেই সেই প্রমোদ গগৈ, সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য, সর্বানন্দ সনোয়াল বাঙালিকে হিন্দু-তফসিলি এবং হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধে বিভাজিত করতেই থাকবে। তিরিশ বছর ধরে নিশ্চেষ্ট বাঙালি রিপ ভ্যান উইঙ্কলের চেয়েও গাঢ় ঘুমে ডুবেছিল। আমরা এখনও কী হিন্দু এবং মুসলমান হয়ে মধ্যযুগীয় জীবন-ভাবনার দিকে পিছন-পানে হাঁটতে থাকব আর ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রশক্তি কেড়ে নেবে আমাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার?
তেরো শতকে তাইল্যান্ড থেকে অহোমরা এসেছিল। খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীগুলিতে অন্য অস্ট্রিক-নিষাদ-চিনা জনগোষ্ঠী এসেছিল। যখন সমগ্র পূর্ব ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানচিত্র অন্য রকম ছিল, সেই চতুর্থ থেকে অষ্টম শতাব্দীতে বাঙালিরাও এসেছিল কামরূপে। আসলে এই তো সভ্যতার ইতিহাস! প্রব্রজন-অভিবাসী এবং এই সূত্রে সংস্কৃতি-বিশ্ববীক্ষা-জনগোষ্ঠীর সহাবস্থানমূলক বিবর্তন। কিন্তু আক্রোশ ও বিদ্বেষ যাদের যুক্তি বা কুযুক্তির মূলাধার, এ সব তথ্য ও সত্য তো তাদের দরকার নেই। বঙ্গাল খেদা, বিদেশি খেদা, আইএমডিটি হয়ে ওরা পৌঁছে গিয়েছে তুরূপের তাসে। তাই যদি বা লিগ্যাসি ডেটা-সহ নাগরিক পঞ্জির দরখাস্ত পেশ করাও হয়, প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে ব্যবস্থা করাই আছে, ইচ্ছে মতো সেই সব নাকচ করা হবে। নইলে বলা হবে, হারিয়ে গিয়েছে!
১৯৫১-র ভোটার-তালিকা তো এক কপি মাত্র ছাপা হয়নি যে একটি মাত্র সরকারি দফতরে তা মজুত থাকবে! ‘হারিয়ে গিয়েছে’ শুনে কেউ এক বারও প্রশ্ন করেনি: সবেধন নীলমণি তালিকাটি কী ভাবে হারাতে পারে? নাকি এর পিছনে চক্রান্তের পাটিগণিত বিশ শতকের অবিভক্ত ভারতে স্বাভাবিক বসতি গড়ে তোলার সময় কিংবা ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যে যারা কৃত্রিম মানচিত্রে এ দিকে চলে এসেছিল—তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করার গভীর ষড়যন্ত্রে অসমের প্রশাসন শরিক! এই জরুরি প্রশ্ন না তোলাতেই ইতিহাস-বিস্মৃতির সুযোগ পুরো মাত্রায় নিচ্ছে অসমিয়া আধিপত্যবাদ। নাগরিক পঞ্জির জন্য আতঙ্কিত দৌড়ে লোককথার খরগোশের মতোই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে বলছে: পৃথিবী ভেঙে যাচ্ছে, পালাও! পালাও! অসমের বাঙালির যখন অস্তিত্ব বিপন্ন, তখন পশ্চিমবঙ্গ বা যে-কোনও জায়গার বাঙালিরা কেন উপ-ভাষাভাষী কম-বাঙালিদের জন্য কুম্ভীরাশ্রুও পাত করছেন না! কোনও জাতীয় সংবাদপত্র কেন সর্বনাশের এই প্রহর সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ করছেন না! যে যুক্তি অসমিয়া আধিপত্যবাদ দেখাচ্ছে—কন্নড়-মরাঠি-হিন্দি-তেলুগুভাষীরাও যদি তা তাঁদের রাজ্যে দেখান, ভারত তবে কোথায় থাকবে?
(লেখক আসাম কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য)