মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা। ছবি: সংগৃহীত।
শিলংয়ের বুকে পোস্টার পড়েছিল- ‘মেঘালয়ের সব বাঙালিই বাংলাদেশি’, ‘বাঙালি মেঘালয়, মিজোরাম, অসম, ত্রিপুরায় তোমাদের অত্যাচার বন্ধ করো’। এ নিয়ে পড়শি বরাক উপত্যকা তো বটেই, এমনকি কলকাতার বাঙালিরাও বিক্ষোভ-প্রতিবাদ দেখিয়েছে। কিন্তু কোনও প্রতিবাদ আসেনি স্থানীয় বাঙালিদের কাছ থেকে। এত দিন পরে শিলং তথা মেঘালয়ের বাঙালিরা প্রথম বার ভাষাগোষ্ঠী হিসেবে একজোট হয়ে প্রতিবাদপত্র পাঠাল মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমাকে।
রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মানস চৌধুরী বলেন, “গত ১৫০ বছরের মধ্যে প্রথম বার মেঘালয়ের বাঙালি একজোট হয়েছে। অতীতে ব্রিটিশ শাসকের কুনজরে পড়ার ভয়ে শিলংয়ের বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত প্রকাশ্য জনসমাবেশ করে সংবর্ধনা দেওয়ার সাহস দেখায়নি। আগে ইংরেজদের ভয়, স্বাধীনতার পরে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভয়ে বাঙালি বরাবর নিজেদের খোলসের মধ্যে আটকে রেখেছে। গলা তোলেনি। কিন্তু এ বার খাসি ছাত্র সংগঠনের বাঙালি-বিরোধী মনোভাবের বিরুদ্ধে তারা প্রথম বার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।”
প্রাক্তন আমলা, অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, সমাজসেবী, সাহিত্যিক, আইনজীবী, বর্তমান শিক্ষক, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, ডাক্তার-সহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার বাঙালিরা প্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষর করেছেন। বলা হয়েছে, মেঘালয়ের সব বাংলাভাষীকে যে ভাবে বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দিয়েছে খাসি ছাত্র সংগঠন— তা দুঃখজনক, দুর্বিনীত, অন্যায় কাজ। ইংরেজরা আসার আগে থেকে বাঙালিদের সঙ্গে মেঘালয়ের যোগ। সিলেট, ময়মনসিংহ ও আশপাশের মানুষের সঙ্গে বাণিজ্য চলত ভূমিপুত্রদের। মেঘালয় নামটাও এক বাঙালিরই অবদান। এত শতক ধরে এখানকার খাসি, গারো, জয়ন্তীয়াদের সঙ্গে বাঙালির সম্প্রীতির সম্পর্ক।
প্রথমে চেরাপুঞ্জি পরে শিলংকে অবিভক্ত অসম ও শ্রীহট্টের রাজধানী করার পরে এখানকার প্রশাসনিক কাঠামোও বাঙালিরাই তৈরি করে। শিলং শহরে বিদ্যুৎ এনেছেন এক বাঙালি। এখনও শিলংয়ের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্রের মালিকও এক বাঙালি। ষাটের দশকে পার্বত্য রাজ্য ও ভাষার দাবিতে লড়াই চলার সময় এখানকার বাঙালিরা পাহাড়ি জনজাতির পাশে, মেঘালয়ের নেতাদের পাশে থেকেছেন। শিলংয়ে দু’ডজন স্কুল, ছ’টি কলেজ বাঙালিরাই তৈরি করেছেন। রাজ্য প্রশাসন-পুলিশ-বিচারব্যবস্থার বিভিন্ন পদে বাঙালিরা দায়িত্ব সামলেছেন।
স্মারকপত্রে মনে করানো হয়েছে, ১৯৭৯ সালের দাঙ্গায় এই সম্প্রীতির ক্যানভাসে প্রথম রক্ত ও আগুন লাগে। ৫০ জনের প্রাণ যায়। বহু বাঙালি ঘরছাড়া, রাজ্যছাড়া হন। অনেকের দোকান-বাড়ি পোড়ানো হয়। কিন্তু কোনও হামলাকারী সাজা পায়নি, কোনও বাঙালি ক্ষতিপূরণ পাননি। মেঘালয়ে বাঙালির সংখ্যা এখন নগণ্য। কিন্তু তার পরেও, সব বাঙালিকে ‘বাংলাদেশি ও বহিরাগত’ বলে দাগিয়ে দেওয়া দুর্ভাগ্যজনক ও বাকি বাঙালিকেও রাজ্য ছাড়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি বলেই বোধ হতে বাধ্য। ভারতীয় সংবিধানে শ্রদ্ধা রেখে, মেঘালয়ে বাঙালিদের অস্তিত্বের সঙ্কটকে রুখতে বেশ কয়েক দফা দাবি জানান বাঙালিরা।
তার মধ্যে রয়েছে— মেঘালয় সরকার যেন রাজ্যের ভাষিক বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার, জীবন, সম্পত্তি, ভাষা ও ধর্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেয়। রাজ্যের ভাষিক, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নির্দিষ্ট নীতি তৈরি করা হোক। সরকারি চাকরিতে তাদের কোটা সম্পর্কে স্পষ্ট নীতি ঘোষিত হোক। অ-ভূমিপুত্রদের ট্রেড-লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে ষষ্ঠ তফসিলের নিয়ম মানা হোক। যে কোনও মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দমন করতে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিক রাজ্য সরকার।