আদালতের পথে অভিযুক্ত ট্যাক্সিচালক শিবকুমার যাদব। দিল্লিতে সোমবার পিটিআইয়ের ছবি।
সর্ষের মধ্যেই ভূত। শুক্রবার রাতে সরাই রোহিলায় ‘উবের ট্যাক্সি’তে ধর্ষণের ঘটনায় দিল্লি পুলিশ তুলোধোনা করেছিল উবের সংস্থাকে। আজ উবের পরিষেবাও বন্ধ করে দিয়েছে দিল্লি প্রশাসন। কিন্তু একই সঙ্গে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে দিল্লি পুলিশই।
কেন?
গত কাল দিল্লি পুলিশ দাবি করেছিল, শিবকুমার যাদব নামে ওই চালক সম্পর্কে খোঁজখবর না করে তাকে নিয়োগ করেছিল উবের। অথচ আজ একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই শিবকুমারকে এ বছর অগস্ট মাসে চরিত্রের শংসাপত্র দিয়েছিলেন খোদ দিল্লি পুলিশেরই অতিরিক্ত ডিসিপি। ঘটনাচক্রে সেই পুলিশই আবার আজ জানিয়েছে, শিবকুমার এই প্রথম ধর্ষণে অভিযুক্ত, এমন নয়। ২০১১ সালেও ধর্ষণের দায়ে সাত মাস জেল খেটেছে সে। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না জেনেই কী ভাবে অতিরিক্ত ডিসিপি শিবকুমারকে শংসাপত্র দিয়ে দিলেন, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। যদিও বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে দিল্লি পুলিশপ্রধান বি এস বাসি দাবি করেছেন, ওই শংসাপত্রটি জাল। যে অতিরিক্ত ডিসিপি-র সই রয়েছে শংসাপত্রে, তাঁর পোস্টিং-ই দিল্লিতে নয়। কিন্তু তাতে বিতর্ক থামেনি।
চাপের মুখে দিল্লি প্রশাসন আজ রাজধানীতে উবের ট্যাক্সি পরিষেবাই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কেন্দ্রের তরফে বলা হচ্ছে, এই নিষেধাজ্ঞা গোটা দেশেই বলবৎ হতে পারে। সংস্থার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার কথাও ভাবছে পুলিশ। তবে পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত হলো, তা নিয়ে বিতর্কও রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর চলন্ত বাসে যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছিল নির্ভয়া, তা ভোলার নয়। কিন্তু তাই বলে কি মেয়েরা বাসে ওঠা বন্ধ করে দিয়েছেন? কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহমেদ অভিযোগ করছেন, “এ এক আজব সিদ্ধান্ত। এ বছরই দিল্লি পুলিশ ওই ট্যাক্সিচালককে শংসাপত্র দিয়েছে। তার ভিত্তিতেই তাকে কাজে নিয়েছিল বেসরকারি সংস্থাটি। এর পর যদি কোনও বাসে বা মেট্রো রেলে এমন ঘটে, সে সবও বন্ধ করে দেবে সরকার?”
ভিন্ন মতও অবশ্য আছে। প্রশাসনের এই কড়া পদক্ষেপে হয়তো অন্য রেডিও ট্যাক্সি সংস্থাগুলি আরও সচেতন হয়ে চালক নিয়োগ করবে আশা করছেন কেউ কেউ। দিনভর এই বিতর্কের মধ্যেই আজ দিল্লির আদালতে তোলা হয় শিবকুমারকে। তাকে তিন দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট অম্বিকা সিংহ। শিবকুমারকে জেরা করে অনেক তথ্য জেনেছে পুলিশ। নিগৃহীতার বয়ানের সঙ্গে তা অনেকাংশে মিলছে বলেও দাবি তাঁদের। কিন্তু তদন্তকারী এক অফিসার জানিয়েছেন, শিবকুমারের মধ্যে অনুতাপের চিহ্ন দেখেননি তাঁরা। উল্টে সে নির্লিপ্ত ভাবে বলেছে, “গলতি হো গয়ি সাব। কেয়া করুঁ আব?” তার বয়ান অনুযায়ী, তরুণীকে ঘুমোতে দেখে সে গাড়ি নিয়ে এগোতে থাকে। তরুণীর বাড়ির চার কিলোমিটার আগে নজাফগড়ে থেমে যায়। তরুণী জেগে উঠতেই তার গলা টিপে ধরে বলে, “চেঁচালেই মেরে ফেলব।”
পুলিশ জেনেছে, শিবকুমার মথুরা ছেড়ে পালানোর ছক কষছিল। বছর কয়েক আগে নিজের বিধবা বৌদিকে বিয়ে করে সে। প্রথম পক্ষের একটি ছেলেও আছে। শুক্রবারের ঘটনার পরে নিজের সিমকার্ড বদলে ফেলে শিবকুমার। বাড়িতে জানায়, সে একটি বচসায় জড়িয়ে পড়েছিল। তাকে ভুয়ো মামলায় ফাঁসানো হতে পারে। তাই দ্রুত সবাই মিলে পালাতে হবে। তার আগেই অবশ্য তার নাগাল পেয়ে যায় পুলিশ।
পুলিশেরই প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে, বছর তিনেক আগে দিল্লিরই মেহেরৌলি এলাকায় শিবকুমারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। তখনও সে ট্যাক্সি চালাত। সে বার গুড়গাঁও থেকে এক মহিলাকে ট্যাক্সিতে তুলেছিল সে। পরে ছত্তরপুরে নির্জন এলাকায় গাড়িতে ধর্ষণ করে সেই মহিলাকে। তিহাড় জেলে সাত মাস সাজা কাটিয়ে মুক্তি পায় সে। কেন, কী ভাবে ছাড়া পায়, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। শিবকুমারের এই অপরাধের রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও তা কেন দিল্লি পুলিশের নজর এড়িয়ে গেল, সেটাও অস্পষ্ট। পুলিশের ভূমিকায় তাই ক্ষুব্ধ দিল্লিবাসী। তাঁদের প্রশ্ন, পুলিশের শংসাপত্র না পেলে কি উবের শিবকুমারকে নিয়োগ করত? পুলিশের ভুলের মাসুল কেন দিতে হল আরও এক জন নিরপরাধ মহিলাকে?
ঘটনাটি নিয়ে আলোড়ন হয়েছে লোকসভাতেও। আজ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ সংসদে এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, “এই নৃশংস কাজের তীব্র নিন্দা করছে সরকার। আমরা আশ্বাস দিচ্ছি, বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।” কিছু দিনের মধ্যেই দিল্লিতে বিধানসভা ভোট। তার আগে নিরাপত্তার প্রশ্নে ফের সরব হচ্ছেন বিরোধীরা। ট্যাক্সিচালকের শাস্তি চেয়ে আম আদমি পার্টির সদস্যরা আজ রাজনাথ সিংহের বাড়ির বাইরে বিক্ষোভ দেখান। রাহুল গাঁধীর নির্দেশে যন্তর মন্তরে বিক্ষোভে সামিল হন কংগ্রেস-কর্মীরা।