মসজিদে তাণ্ডব। ফাইল চিত্র
দু’জনেই অযোধ্যাবাসী। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রত্যক্ষদর্শী।
দু’জনের থাকার জায়গার মধ্যে দূরত্বও পায়ে হাঁটা। তবে মনের দূরত্ব কমেনি তিন দশক পরেও। কারণ, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর নিজের বাড়ি থেকে হাজি মেহবুব যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস হতে দেখছেন, তখন হাজারিলাল চড়ে তার গম্বুজে! বিদেশি, ‘বিজাতীয়’ ঔদ্ধত্যের নিশানকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে প্রাণপণে ঘা মেরে চলেছেন তিনি।
তার পর সরযূ দিয়ে জল অনেক গড়িয়েছে। এত দিনে বয়স কম-বেশি থাবা বসিয়েছে দু’জনের শরীরে। দু’জনেই বলছেন যে, প্রায় ত্রিশ বছর পেরিয়ে এসে আর পুরনো কথা তোলা অর্থহীন। কিন্তু বিতর্কিত কাঠামো ধ্বংসের কথা উঠলে, চনমনে গলায় হাজারিলাল বলছেন, “১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর দুপুরে বিতর্কিত কাঠামোয় ধাক্কা দেওয়া শুরু।… কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সূর্য ডোবার আগেই ‘জঞ্জাল’ সাফ। রামমন্দিরের শিলান্যাসে জীবন সার্থক। আর এ সব পুরনো কথায় কী হবে?” আর বিষাদ দলা পাকিয়ে উঠছে মেহবুবের গলায়। বলছেন, “চোখের সামনে (বাবরি) মসজিদকে ‘শহিদ’ হতে দেখেছি। হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে কেন্দ্র-রাজ্য-পুলিশ-প্রশাসন।… মসজিদ ধ্বংসের কথা মেনেও আইন যখন সেখানে মন্দির তৈরির অনুমতি দিয়েছে, তখন আর পিছনে তাকিয়ে লাভ কী?”
‘দু’পক্ষের’ মধ্যে অবিশ্বাসের পরিখাও কি আর ভরাট হবে কোনও দিন? স্থানীয় অনেকের অভিযোগ, ডিসেম্বরে অযোধ্যায় প্রাণঘাতী গোষ্ঠী সংঘর্ষে ইন্ধন ছিল মেহবুবেরও। তাঁর বাড়ি থেকে আক্রমণ করা হয়েছিল চোদ্দ ক্রোশি পরিক্রমায় আসা অনেক তীর্থযাত্রীকে। আবার ওই মহল্লার পাল্টা দাবি, পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেওয়া হয়েছিল তো মেহবুবের বাড়িই। নেহাত বরাত জোরে বেঁচে গিয়েছিল মেহবুবের ১০ আর ১২ বছর বয়সি দুই সন্তান।
আরও পড়ুন: বাবরি-বিতর্কের ইতিহাস
আরও পড়ুন: বাবরি মসজিদ নির্মাণ থেকে ধ্বংস, পাঁচ শতকের সালতামামি
তাই স্থানীয় শাহবুদ্দিন, ইজহার হুসেন, ইত্তকাদ হুসেনদের মুখে চেনা আক্ষেপ, “প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমরা যেখানে নমাজ পড়তে গিয়েছি, সেই প্রার্থনাস্থল মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হল। দিনের আলোয়। সকলের সামনে!” কেউ মসজিদ ধ্বংস হতে দেখার কথা বলেন, কাউকে তাড়া করে তার পরে উত্তরপ্রদেশ জুড়ে গোষ্ঠী সংঘর্ষের আতঙ্ক। ওই সময়ে একই দিনে স্বামী এবং ছেলেকে খুন হতে দেখা তাহিরা বেগম যেমন এক বার বলেছিলেন, “মসজিদ তো গিয়েছেই। আর গিয়েছে বহু মানুষের জীবন। যা কখনও ফেরার নয়।”
উল্টো ছবি করসেবকদের শিবিরে। মসজিদ ভাঙা নিয়ে বিন্দুমাত্র অনুতাপ কিংবা গ্লানির প্রশ্ন নেই। বরং রামজন্মভূমিতে মোগল সম্রাটের সেনাপতির মসজিদ তৈরির ‘ঔদ্ধত্য’কে গুঁড়িয়ে দিতে পেরেই গর্বিত তাঁরা। খুশি, রামলালাকে তাঁর ঘর ফিরিয়ে দিয়ে। তার জন্য লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশীদের মতো তাবড় নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার কথা উঠলে, করসেবকরা স্থির বিশ্বাসে বলেছেন, “ও কিচ্ছু হবে না।” পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, “আমাদের কত জনকে যে মুলায়ম-সরকার গুলি করে মেরেছিল, তার বেলা? সেই হিসেব রাখে কে?”
হাজারিলালের দাবি, “রামচন্দ্রজির ‘সেবায়’ আমি এবং আমার মতো অনেকে হাসিমুখে জেলে যেতে রাজি।” অযোধ্যার রামনগরীতে ডেরা বাঁধা রামসেবক দাস, সিয়ারাম দাস, কমলা মহারাজ, কমল পাণ্ডেরাও সুপ্রিম কোর্টে রামমন্দির মামলার রায় বেরনোর দিনে নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, “করসেবায় যুক্ত ছিলাম। শামিল ছিলাম মসজিদ ধ্বংসে। আজ বড় আনন্দের দিন। বহু প্রতীক্ষিত সুখবর এল।” তবে হ্যাঁ, এঁদের অনেকেরই বক্তব্য, করসেবার দরুন কোনও গোষ্ঠী সংঘর্ষ কিংবা প্রাণহানি তাঁরা চাননি। তা হলে এত হিংসা ছড়াল কী ভাবে, তা অবশ্য লাখ টাকার প্রশ্ন।
নব্বইয়ের দশকের উত্তপ্ত রামমন্দির আন্দোলন, মসজিদ ধ্বংস এবং তার পরের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কথা মনে করলে, আজও শিউরে ওঠে অযোধ্যা। দ্রুত অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে চান মেহবুব। হাজারিলাল তোলেন বদলে যাওয়া অযোধ্যায় ‘স্বপ্নের’ রামমন্দির তৈরির কাজ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। প্রথম জনের কাছে আডবাণী অপরাধী। দ্বিতীয় জনের কাছে ডাকাবুকো নেতা। প্রথম জন বুধবার ‘দোষীদের’ শাস্তির প্রত্যাশী। দ্বিতীয় জনের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়াও আসলে রামচন্দ্রের সেবা।
তিন দশক পেরিয়েও ৬ ডিসেম্বর পিছু ছাড়েনি কোনও পক্ষেরই।