National news

‘আমরাও তো হিন্দু, তা-ও কেন জায়গা নেই মোদীর ভারতে?’

তাঁর আঙুল অনুসরণ করে দেখলাম, পাহাড়ের নীচে কোমর সমান বাবলা বন আর বড় বড় পাথরের মাঝখানে মাথা তুলে রয়েছে কয়েকটা তাঁবু।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

জোধপুর শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৬:০৬
Share:

১৫ বছর ধরে প্রাণে বাঁচতে পাকিস্তান থেকে চলে এসেছে হিন্দু পরিবারগুলো। মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এখনও তাঁরা ভারতীয় নাগরিকত্ব পায়নি।

জসবন্ত সাগর গ্রামের রাস্তা থেকেই পাশের পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে মঙ্গারাম বললেন,“উও রহা পাকিস্তানি কা ক্যাম্প।” তাঁর আঙুল অনুসরণ করে দেখলাম, পাহাড়ের নীচে কোমর সমান বাবলা বন আর বড় বড় পাথরের মাঝখানে মাথা তুলে রয়েছে কয়েকটা তাঁবু।

Advertisement

মঙ্গারামের দেখানো বালির উপর দিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে কিছু দূর এগনোর পর বোঝা গেল, ওগুলো তাঁবু নয়। নারকেল পাতা, ঘাসে ছাওয়া প্রায় শ’খানেক ঝুপড়ি। এ রকমই একটি পাতায় ঘেরা ঘরে থাকেন রামচন্দ্র সোলাঙ্কি। গত চার বছর ধরে এই ঝুপড়িই রামচন্দ্রের ঠিকানা।

২০১৪ সালের এক রাতে নিজের ভিটে ছেড়ে, সর্বস্ব রেখে রওনা দিয়েছিলেন মিরপুর খাস থেকে। তারপর প্রায় দু’দিন পরে সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছেছিলেন এখানে। এখনও তাঁর মনে আছে সেই রাতের কথা। তিনি বলেন, ‘‘পালিয়ে আসা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় ছিল না। কারণ তার ক’দিন আগেই আমার এক আত্মীয়ের কিশোরী মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে জমিদারের ছেলেরা। মেয়েটি মুখ খোলায় জমিদারের লোকেরা পরিবারের পাঁচজনকে মেরে দেয়। তারপর আর ভরসা করে থাকতে পারিনি।” শুধু রামচন্দ্র নন। গত ১৫ বছরে পাকিস্তান থেকে এভাবেই পালিয়ে এসেছেন হাজার হাজার পাকিস্তানি হিন্দু পরিবার। মূলত পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ থেকে। সীমান্তের উল্টোদিকেই রাজস্থান। সীমান্ত পেরিয়ে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন এ দেশে। সেই শরনার্থী পাকিস্তানি হিন্দুদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার মানুষ থাকেন জোধপুরে। শহরের উপকণ্ঠে এ রকম ফাঁকা অনাবাদি জমিতে ঝুপড়ি বানিয়ে।

Advertisement

দেখুন ভিডিয়ো:

একই ভাবে চলে এসেছিলেন ভিয়োজি মাকওয়ানা। তিনি বলেন, “জমিদারের লোকজন হিন্দুদের গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। মুসলমান করার চেষ্টা করছিল। তাই পালিয়ে এসেছি।” তিনিও প্রায় চার বছর ধরে এই বসতিতে বাস করছেন। এখনও পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশে বেশ কয়েক হাজার হিন্দু রয়েছেন যারা মূলত ছোট ব্যবসায়ী নয়তো কৃষি শ্রমিক। এঁদের অধিকাংশই এসেছেন ভারতে তীর্থ করার নাম করে ১৫ দিন, বড় জোর এক মাসের ভিসা নিয়ে। প্রথম দিকে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করতেন। এখন আর বাড়ে না। অনেকেই আছেন যাঁরা এ দেশে এসেছেন ১০ বছরেরও বেশি সময় আগে। দীর্ঘদিন ধরে এই শরণার্থী পাকিস্তানিদের দাবি নিয়ে লড়ছেন জোধপুরের সমাজকর্মী হিন্দু সিংহ সোধা। তিনি বলেন,“রাজস্থান হাইকোর্টও এঁদের নাগরিকত্ব দিতে বলেছে সরকারকে। এপ্রিল মাসে এখানকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী গুলাব চাঁদ কাটারিয়া বলেছিলেন পাঁচ হাজার জনের নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজ শুরু হবে। কিন্তু তারপরও বিশেষ কিছু এগোয়নি।” কোর্ট বা সরকারের এত মারপ্যাঁচ জানেন না এখানকার বাসিন্দারা। তাঁরা এসেছিলেন একটা স্বপ্ন নিয়ে। রামচন্দ্র বলেন,“ভারত সরকার বার বার বলেছে পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু শরনার্থীদের নাগরিকত্ব দেবে। সেই আশাতেই প্রাণ বাঁচাতে চলে এসেছিলাম এখানে।”

শরণার্থী শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা করেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

রামচন্দ্র, ভিয়োজিদের নাগরিকত্ব নেই। অন্যদিকে ভিসারও মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছে। তাই শহর থেকে দূরে গ্রামে গ্রামে দিনমজুরিই একমাত্র ভরসা তাঁদের। সেই কাজ পাওয়াও খুব একটা সহজ নয়। ভিয়োজি বলেন, “মাসে ১০ থেকে ১২ দিন কাজ পাই। এখানকার মানুষও আমাদের বিশ্বাস করতে পারেন না। কারণ আমরা পাকিস্তানি।” মনে পড়ে গেল জশোবন্ত সাগর গ্রামের মঙ্গারামের কথা। পাকিস্তানি হিন্দুদের ক্যাম্প কোথায়? প্রশ্নটা শুনেই বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে গিয়েছিল মঙ্গারামের।

বাজার থেকে পাতা কিনে এনে এ ভাবেই ঘর বানিয়ে থাকছে ওই পরিবার।

নাগরিকত্ব দূর অস্ত্‌। ন্যুনতম সরকারি সাহায্যও জোটেনি এঁদের। রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতা বলেন,“এই পাতার ঝোপড়া তৈরি করতেই লেগে যায় ১০ হাজার টাকা। আমরা বাজার থেকে পাতা কিনে এনে নিজেরা বানিয়েছি।” এই বসতির পাশ দিয়ে জোধপুর নগর নিগমের জলের পাইপলাইন গেলেও এঁদেরকে জল কিনতে হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবার কথাও এঁরা চিন্তাও করতে পারেন না। ভরসা বেসরকারি চিকিৎসক, যার খরচ তাঁদের আয়ত্বের বাইরে। বিদ্যুৎহীন, জলহীন এই বসতিতেই অনাগরিক হয়ে বড় হচ্ছে এঁদের সন্তানরা। যারা পাকিস্তানে স্কুলে পড়ত। কিন্তু এখানে স্কুলে জায়গা পেতে গেলেও অভিভাবকের নাগরিক প্রমাণপত্র লাগে। কয়েক মাস ধরে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শরণার্থী শিশুদের প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তার পর?

আরও পড়ুন: ‘হিন্দু-মুসলমান একই ব্যবসা করি, এমন হবে কোনও দিন ভাবতে পারিনি’

ভিয়োজির প্রৌঢ় স্ত্রী ঝুলকা বলেন,“যাই হোক না কেন, আমাদের এখানেই থাকতে হবে। কারণ পাকিস্তানে ফেরার রাস্তা বন্ধ।ওখানে ফিরলে প্রাণ চলে যাবে।”

আরও পড়ুন: রানির গদি ওল্টাতে রানিই ভরসা কংগ্রেসের, ভয়ও তাঁর ‘সম্মোহনী’ ক্ষমতাকেই

বিনা পয়সায় জলও পান না তাঁরা।

দিনের আলো কমে আসছে। গোটা বসতির উপর পাশের পাহাড়ের ছায়াটা লম্বা হচ্ছে। তখনই কানে এল শাখের আওয়াজ। সীতা পাশের একটি বড় পাথরের উপর লাল পতাকা দেখিয়ে বলেন, “পাকিস্তানে আমাদের উপাস্য দেবী মাতা হিংলাজ। আমরা এখানে সেই দেবীকেই প্রতিষ্ঠা করেছি।” তাকিয়ে দেখলাম দেবী হিংলাজের লাল নিশানের পাশে উড়ছে ভারতের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা। তারই মাঝে ভিয়োজির কিশোর ছেলে অর্জুনের প্রশ্নটা ভেসে এল,“মোদী সরকার, বসুন্ধরা সরকার সবাই এত হিন্দুত্বের কথা বলে। তাহলে হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কেন জায়গা নেই মোদীর ভারতে?” উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, তার মাঝেই চোখে পড়ল মাথায় বড় বড় গাঠরি, পোঁটলা-পুটলি নিয়ে ক্লান্ত পায়ে ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে একটি পরিবার। রামচন্দ্রর দিকে তাকাতেই তিনি বলেন,“ ওঁরা আজই এলেন পাকিস্তান থেকে।”

ছবি: সিজার মণ্ডল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement