রাহুল গান্ধী এবং মল্লিকার্জুন খড়্গে।
গুজরাত এবং হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে আবারও বেআব্রু হল কংগ্রেসের করুণ দশা। ছ’রাজ্যের সাতটি বিধানসভা আসনের মধ্যে মাত্র তিনটি আসনে লড়েছিল হাত শিবির। তার মধ্যে দু’টি জেতা আসন ছিল। সেই দু’টি আসন তো হাতছাড়া হলই। তার মধ্যে একটিতে আবার ঠাঁই হল তৃতীয় স্থানে। দলের নতুন সভাপতি নির্বাচনের ঠিক পর পর এবং রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র মাঝেই ঘটল এই বিপর্যয়।
হরিয়ানা, তেলঙ্গানা এবং ওড়িশার তিন কেন্দ্রের উপনির্বাচনে লড়েছে কংগ্রেস। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং বিহারের চার আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী দেয়নি তারা। হরিয়ানার আদমপুর এবং তেলঙ্গানার মুনুগোড়ে ছিল হাত শিবিরের জেতা আসন। দু’টি আসনই এ বার হাতছাড়া হল। আদমপুর আসনে কংগ্রেস প্রার্থী জয় প্রকাশকে ১৬ হাজার ৬০৬ ভোটে পরাস্ত করেছেন বিজেপি প্রার্থী এবং রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভজন লালের নাতি ভব্যা বিষ্ণোই। মুনুগোড়ে আসনে তো আঁচড়ই কাটতে পারল না কংগ্রেস। ওই আসন এবং ওড়িশার ধামনগরে হাত-প্রার্থীর জায়গা হল তিন নম্বরে।
২৪ বছর পর গত অক্টোবর মাসেই কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচনী লড়াই হয়েছে। সীতারাম কেশরীর পর আবার গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ ওই পদে বসলেন। পাহাড়প্রমাণ চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়ে ‘অধিনায়ক’ হয়েছেন মল্লিকার্জুন খড়্গে। তাঁর প্রথম লড়াই ছিল— এই ছ’রাজ্যের উপনির্বাচন। গুজরাত ও হিমাচলপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সেই উপনির্বাচনে পরাজয় বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন দলের একাংশ। তাঁদের অভিমত, দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে গুজরাতে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সে রাজ্যে খুব একটা স্বস্তিতে নেই। প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া তৈরি হয়েছে। কিন্তু অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আপ ভোট কেটে বিজেপিকে ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ করে দেবে কি না, সে নিয়ে দল যথেষ্ট চিন্তায় আছে। হিমাচলেও কংগ্রেসের সাংগঠনিক অবস্থা খুব একটা পোক্ত নয়। তাই, এই উপনির্বাচনই ছিল দলীয় কর্মীদের মানসিক ভাবে চাঙ্গা করে তোলার বড় সুযোগ।
দলের অন্য একটি অংশের অবশ্য পাল্টা যুক্তি, যে সময় ছ’রাজ্যের উপনির্বাচন ঘোষিত হয়, সেই সময় গোটা দলই সভাপতি নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাই, উপনির্বাচনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। নতুন সভাপতি নির্বাচিত হলে তাঁর নেতৃত্বে গুজরাত এবং হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনকেই পাখির চোখ করে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। তা ছাড়া, এই মুহূর্তে সব চেয়ে বড় লক্ষ্য— ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে দলের সংগঠনকে মজবুত করা। সারা দেশেই এখন কংগ্রেসের সংগঠনের বেহাল দশা। ছত্তীসগঢ় ও রাজস্থান ছাড়া আর কোনও রাজ্যে ক্ষমতায় নেই দল। ক্ষয়িষ্ণু সংগঠনকে পুনরুজ্জীবিত করে মজবুত করতে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে কাজ শুরু হয়েছে। সেই জায়গায় উপনির্বাচন নিয়ে না ভেবে একটু একটু করে দলে সামগ্রিক ভাবে বদল আনাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছেন নেতৃত্ব। আর তা ছাড়া, উপনির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের উৎসাহ এমনিতেই কম থাকে। ভোটের পরেও একই সরকার থাকবে, একই প্রশাসন থাকবে, ক্ষমতার ভারসাম্য একই থাকবে, এই ভেবে অনেকেই উপনির্বাচনকে গুরুত্ব দেন না।
যদিও এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য বলে মানতে পারছেন না অনেকে। বাংলায় রাজ্য স্তরের এক কংগ্রেস নেতার কথায়, ‘‘মাত্র তিনটি আসনে লড়েছে কংগ্রেস। যার মধ্যে দু’টি জেতা আসন। হারা আসন হলে কথা ছিল। কিন্তু জেতা আসনে ধরাশায়ী হওয়া, প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে তিন নম্বরে পৌঁছে যাওয়া মোটেই সুদিনের ইঙ্গিত দেয় না। বরং, এই উপনির্বাচনই বুঝিয়ে দিল, দলের কাঠামোগত সংস্কার কতটা জরুরি!’’
খড়্গে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর রাজনীতির কারবারিদের একাংশের মত ছিল, নতুন অধিনায়কের সব চেয়ে বড় কাজ হতে চলেছে কাঠামোগত সংস্কার, তথা পার্টিকে বর্তমান সময়ের উপযোগী করে তোলা। তাঁদের বক্তব্য, কংগ্রেসের কাঠামোগত সংস্কার না হলে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটানো সম্ভব নয়। এরই সঙ্গে, দলের অন্দরে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে খড়্গের সামনে। দলের নেতাদের একাংশ মনে করছেন, হরিয়ানা এবং তেলঙ্গানায় জেতা আসনে হার খড়্গের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলতে পারে। এই যুক্তি মানতে না চেয়ে এক কংগ্রেস নেতার বক্তব্য, ‘‘এই উপনির্বাচনের ফলাফল মোটেই নবনির্বাচিত সভাপতির ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলবে না। সেই ভাবে দেখলে দলের অন্দরে সনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীর ভাবমূর্তিতেই প্রভাব পড়ার কথা। তা তো কখনওই ঘটেনি। বড় লক্ষ্য নিয়ে ময়দানে নামলে সময় তো দিতেই হবে।’’ তবে, দলে যে আমূল পরিবর্তন দরকার, তা কার্যত সব নেতাই এক বাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছেন।