National News

গুয়াহাটির গাঁধী মণ্ডপে গাঁধী মূর্তি সরানো নিয়ে বিতর্ক

বিজেপি বিধায়ক সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “মূর্তিটা দেখেছেন! কোনও ভাবেই মহাত্মা গাঁধী বলে মনে হয় না। হাত-পাগুলো অসমান। মুখটা বিকৃত, চশমাও। সে জন্যই ওই মূর্তি সরিয়ে তার জায়গায় আমরা অন্য মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৭ ১১:১৭
Share:

রামকিঙ্করের গাঁধী মূর্তি। —নিজস্ব চিত্র।

গুয়াহাটির বুকে শরণিয়া পাহাড়ের চূড়ায় গত ৪৭ বছর ধরে দাঁড়িয়ে তিনি। কখনও তাঁর সিমেন্টের অঙ্গে চুনের পোঁচ পড়েছে। কখনও ফাটল, দাগ ঢাকা হয়েছে প্লাস্টিক পেইন্টে। কালো, বেখাপ্পা চশমায় চোখ ঢেকেছে গাঁধী মণ্ডপের মহাত্মা মূর্তি। কিন্তু, সেই মূর্তিতে যে খোদ রামকিঙ্কর বেজের ছোঁয়া রয়েছে— সেটাই জানতেন না এখনকার মন্ত্রী-আমলারা। মূর্তির ফলকেও কোথাও শিল্পীর নামোল্লেখ নেই। বিসদৃশ মূর্তিটি সরিয়ে নতুন মূর্তি বসানোর সিদ্ধান্ত যখন প্রায় পাকা, তখনই জানা গেল শিল্পীর নাম। এ ভাবে রামকিঙ্করের মূর্তি হঠিয়ে নতুন মূর্তি বসানোর সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। শেষ পর্যন্ত প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূর্তিটি কেন্দ্রস্থল থেকে সরিয়ে নিলেও গাঁধী মণ্ডপের মধ্যেই অন্যত্র বসানো হবে।

Advertisement

পাহাড়ি পথ বেয়ে গাঁধী মণ্ডপে ওঠা গুয়াহাটির প্রাতভ্রমণকারীদের জনপ্রিয় রুটিন। আগে গাঁধী মণ্ডপ দিনভর অবারিত দ্বার ছিল। ভিতরের সংগ্রহশালা পড়ে ছিল তালা বন্ধ। কিন্তু বছর দুয়েক আগে সংগ্রহশালা খোলে। ভিতরে গাঁধীজির অনেক বিরল ছবি, হাতের লেখা, তাঁতযন্ত্র রয়েছে। তৈরি হয়েছে টিকিট কাউন্টার। রাস্তা থেকে মণ্ডপ পর্যন্ত সিমেন্টের চওড়া রাস্তা হয়েছে। এমনকী, সৌন্দর্যায়ণের নামে এখন গাঁধী মণ্ডপের ভিতরে ঘাসের জমিও ঢেকে দেওয়া হয়েছে কংক্রিটে। তা নিয়ে পরিবেশপ্রেমী ও প্রাতভ্রমণকারীদের বেজায় আপত্তি ছিল।

কিন্তু বর্তমান গাঁধী মূর্তির আকৃতি, লাঠি ও পায়ের গড়ন নিয়ে অনেকেরই আপত্তি ছিল। প্রায়ই তা নিয়ে বিদ্রূপ চলত। মূর্তিটি গায়ে অনেক ফাটল ধরেছিল। মূর্তিতে প্রতি বছর ২ অক্টোবর রঙের পোঁচ দেওয়া হত। জোড়াতালি দিয়ে কালচে একটি চশমা গাঁধীজির চোখের উপরে বসিয়ে দিলেও বাঁকাচোরা চশমা মূর্তিকে আরও হাস্যকর করে তোলে।

Advertisement

আরও পড়ুন

১২ ঘণ্টার নাটকের শেষে ফটোফিনিশে জয় আহমেদ পটেলের

এই অবস্থায় রাজ্য সংস্কৃতি দফতর ও জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয়, মূর্তিটি সরিয়ে ফেলা হবে। সেখানে তৈরি করা হবে নতুন মূর্তি। বিষয়টি নিয়ে গত কাল জেলাশাসক এম আঙ্গামুথুর নেতৃত্বে একটি বৈঠকও হয়। সেখানে হাজির ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী নবকুমার দোলে, পূর্ব গুয়াহাটির বিধায়ক সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য, মহাত্মা গাঁধী ও শহীদ স্মৃতি ন্যাস এবং গাঁধী মণ্ডপ ট্রাস্টের সদস্য রেণুকা দেবী বরকটকি-সহ অনেকে। সিদ্ধার্থবাবু স্পষ্টই বলেন, ওই মূর্তিটির সঙ্গে গাঁধীজির চেহারা, দৈহিক আদলের কোনও মিল নেই। এতে গাঁধীজির ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। তাই মূর্তিটি বদলে ফেলা দরকার। জেলাশাসক এম আঙ্গামুথু আনন্দবাজারকে জানান, মূর্তিটি কার তৈরি সে ব্যাপারে কোনও স্পষ্ট উল্লেখ ছিল না। তাই জানা ছিল না মূর্তির পিছনে রামকিঙ্কর বেজের অবদান রয়েছে।

গাঁধী সংগ্রহশালার ভিতরের ছবি। —নিজস্ব চিত্র।

ট্রাস্ট সূত্রে খবর, ১৯৬৮ সালে অসম সরকারের অনুরোধে বেজ মূর্তিটি তৈরির দায়িত্ব নিলেও, তাঁর ছাত্ররাই প্রধানত মূর্তিটি তৈরি করেন। ১৯৭০ সালের ২ অক্টোবর, তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বিষ্ণুরাম মেধি মূর্তিটি উন্মোচন করেন। কিন্তু ফলকে কোথাও রামকিঙ্করের নাম উল্লেখ করা ছিল না। মূর্তিটি কলকাতা থেকে আনা হলেও তা রামকিঙ্কর বেজের তৈরি- সে বিষয়ে বৈঠকে হাজির সিংহভাগই অন্ধকারে ছিলেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানির পরে বিতর্ক শুরু হয়। কলাভবনের প্রাক্তনী, প্রবীণ শিল্পী ননী বরপূজারি থেকে শুরু করে অনেক শিল্পী, স্থপতি, স্বাধীনতা সংগ্রামী ওই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন।

আরও পড়ুন

বর্ণিকা-কাণ্ডে মুখ পুড়ছে বিজেপির, সংসদে বিবৃতি দেবেন রাজনাথ

প্রবীণ শিল্পী ননী বরপূজারির মতে, মূর্তিটি রামকিঙ্করের তৈরি বলে সকলেই জানে। আসল মূর্তি সিমেন্টের রঙের ছিল। পরে তাতে খামোকা সাদা রঙ করে মর্য্যাদা ও শিল্পগুণ ধ্বংস করা হয়েছে। তিনি বলেন, “রামকিঙ্করের বিশেষত্বই হল, তিনি মানুষের প্রকৃত আদল আঁকতেন না। মানুষটির চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতেন। তাই গাঁধীজির সঙ্গে মূর্তির চেহারা অবিকল না হতেই পারে।”

অবশ্য শান্তিনিকেতনের কলাভবনের গবেষক ভাস্কর হাজরিকার মতে, গুয়াহাটির গাঁধীমূর্তিটি শান্তিনিকেতনে থাকা রামকিঙ্করের আসল মূর্তির রেপ্লিকা। কলাভবনের মূর্তিতে কোনও রং ব্যবহৃত হয়নি। মূর্তির পদতলে মাথার খুলি। যা বোঝায়, অহিংসা হিংসাকে পদানত করছে। ওই মূর্তিতে চিরপরিচিত চশমাও নেই। কিন্তু গাঁধী মণ্ডপের মূর্তিতে আসল মূর্তির আদল থাকলেও অনেক রদবদল হয়েছে। পাদদেশের নকশা ভিন্ন। ভাস্করবাবুর মতে, মূর্তিটিতে সাদা রঙ করায় তা উজ্জ্বল হলেও চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে বেখাপ্পা হয়ে গিয়েছে। রামকিঙ্কর গাঁধীজির মধ্যে প্রকৃতির আদি রংই রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গাঁধী মণ্ডের মূর্তিতে চশমা ও রঙের জনপ্রিয় ধারা যোগ করে দেওয়া হয়েছ। তাই এটিকে রামকিঙ্করের মূর্তি হিসেবে বলা ঠিক নয়।

ননীবাবুর দাবি, যে কোনও বড় ভাস্কর মূর্তির একটি ‘নেকেড’ বা ক্ষুদ্র আদল বানিয়ে দেন। অনেক সময় তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ছাত্ররা বড় মূর্তির কাজ শেষ করে। এই মূর্তির ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু শিল্পজগতের নিয়মানুযায়ী, তখনও কিন্তু মূর্তিশিল্পী হিসেবে রামকিঙ্করকেই মানতে হবে।

গুয়াহাটি আর্টিস্ট গিল্ডের সভাপতি কিশোর দাস জানান, গাঁধী মূর্তিটির বিষয়ে গিল্ডের তরফে বিশদ খোঁজখবর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তার পরেই এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসের অধ্যাপক রাজকুমার মজুমদার বলেন, “রামকিঙ্কর বেজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মূর্তিটি তৈরি হয়েছিল। তা এ ভাবে ভাল দেখতে হয়নি বলে সরিয়ে ফেলা যায় না। আরও ভাল মূর্তি তৈরি করতে চাইলে করাতেই পারে সরকার। কিন্তু এমন ঐতিহাসিক মূর্তির স্থান অন্য মূর্তি নিতে পারে না।”

জেলাশাসক এম আঙ্গামুথু বলেন, "আমরা ওই মূর্তিটির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত, জনমত নেওয়া হবে। মূর্তিটি কংক্রিটের। ভিতরে অনেক ফাটল রয়েছে। তা সরানো হলেও ওই চত্বরেই সংরক্ষিত থাকবে।"

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement