বটদ্রবা কেন্দ্রে ভোটদানের পরে অসমের বিধায়ক ও অভিনেত্রী আঙুরলতা ডেকা। শনিবার। নিজস্ব চিত্র
এ তো, জগতের সর্বনাশ, তোমার পৌষ মাস! নগাঁওয়ের সফিউর রহমান, চিরাংয়ের কৃষ্ণ রাজবংশীদের (বদলে দেওয়া নাম) এমনই বলেছিলেন পড়শিরা। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আচমকাই ডিটেনশন শিবির থেকে মুক্তির ছাড়পত্র এসেছিল। সৌজন্যে করোনা। করোনা যত কমেছে তত ভয় বেড়েছে ডিটেনশন শিবির থেকে ছাড়া পাওয়া প্রায় চারশো তথাকথিত ‘বিদেশির’। ফের যদি জেলে ফেরার ডাক আসে!
২০১৯ সালের ইদের আগে। বন্যার জল তখনও নামেনি। বকো, সোনতলির মানুষ মাথা গুঁজে রয়েছেন ত্রাণ শিবিরে। হঠাৎই ঘরে ঘরে নোটিস এল, এক দিনের মধ্যে হাজির হতে হবে এনআরসির শুনানিতে। গোলাঘাট, শিবসাগর বা যোরহাটে। দূরত্ব ৪০০ থেকে ৬০০ কিলোমিটার! একা নয়, বংশতালিকায় উল্লেখ থাকা সব সদস্যকে নিয়ে!
চূড়ান্ত এনআরসি প্রকাশের ২৬ দিন আগে এমন ফরমানে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল অসমের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের। সিংহভাগই ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘু। পরের তিন-চারটে দিন দলে দলে অসহায় মানুষ ধার করে, গয়না, জমি, গবাদি পশু বেচে বাস ভাড়া করে শুনানিতে গিয়েছেন। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই। এনআরসিতে নাম তোলার!
২০১৯, ডিসেম্বর। গুয়াহাটি শহরে চলছে গুলি। জনরোষ উপড়ে ফেলছে রাস্তার রেলিং, ভাঙছে সরকারি ভবন, সব হোর্ডিং। ভাঙচুর হচ্ছে গাড়ি। কার্ফুকে সঙ্গী করে ফিরছে অসমিয়া বনাম বাঙালির বিভাজন। পুলিশের গুলি-লাঠিতে প্রাণ দেওয়া পাঁচ অসমিয়া পেলেন সম্মান। কিন্তু ঢেকিয়াজুলিতে ট্রাকের সঙ্গে জ্বালিয়ে দেওয়া অ-অসমিয়া চালক আর তিনসুকিয়ায় দোকানের মধ্যে পুড়িয়ে মারা হিন্দিভাষী প্রৌঢ় থেকে গেলেন আন্দোলনের অনুচ্চারিত ‘কোল্যাট্যারাল ড্যামেজ’ হয়েই!
ডিটেনশন শিবির, এনআরসি আর সিএএ— এই তিন জুজুকে হাতিয়ার করেই এসে পড়েছে ভোট-পর্ব। দেশের মানুষ এ সবের নাম শুনেছেন বটে, কিন্তু হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে অসম। আরও বেশি টের পেয়েছেন অসমের ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুরা। ভোট যত এগিয়েছে, ততই হিসেব গুলিয়ে গিয়েছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার ভাষিক সংখ্যালঘুদের। বিশেষ করে বাঙালিদের সামনে এ বার কোনও গেরুয়া ‘মসিহা’ নেই!
যে কংগ্রেস প্রথম ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অসমে ঢোকা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব এনেছিল, তারাই এখন সিএএ-র প্রধান বিরোধী।
যে বিজেপি ১৯৭১ সালের ভিত্তিতে এনআরসি তৈরি করে গর্বে বুক চাপড়েছিল, তারাই এখন ১৯৫১ সালকে ভিত্তিবর্ষ করে নতুন এনআরসির দাবিতে সরব! ১৯৭১ সালের প্রমাণপত্র জোগাড়েই কালঘাম ছুটেছে, সেখানে ১৯৫১ সালে পূর্বপুরুষের ভারতীয়ত্বের প্রমাণপত্র কোথায় মিলবে! এনআরসি থেকে শুরু করে সিএএ— সব কিছু নিয়েই এক কিম্ভুত খিচুড়ি পাকিয়ে ২০২১ সালে গদি বাঁচাতে চাইছে বিজেপি।
পলিটিকাল জাস্টিস পার্টির রাজ্য সভাপতি শান্তনু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাঙালির সিএএ লাগবে না। অসম চুক্তি অনুযায়ীই তাঁরা নাগরিক। অথচ এনআরসির সময় আদি ভূমিপুত্র হিসেবে অসমিয়াদের থেকে প্রমাণপত্র চাওয়া হল না, প্রমাণ জোগাড়ে নাজেহাল করা হল শুধুই ভাষিক সংখ্যালঘুদের। এক দেশ, এক এনআরসিতে যখন এমন বৈষম্য চলছিল, যখন আমার ঠাকুরদার ২০০ বছর আগের ভারতীয়ত্বের প্রমাণ হাতেও আমি নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে নাকাল হচ্ছিলাম- তখন কোথায় ছিল বিজেপি? তারা আসলে অসমে আগুন লাগিয়ে বাংলায় ফায়দা লুটতে চায়। এনআরসি ও সিএএ-র নামে বাঙালিদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে।’’