অমলকুমার রায়চৌধুরী স্মারক বক্তৃতায় বিজ্ঞানী অশোক সেন। শনিবার প্রেসিডেন্সি কলেজের মেঘনাদ সাহা সভাঘরে। নিজস্ব চিত্র
‘রায়চৌধুরী ইকুয়েশন’ আলবার্ট আইনস্টাইনের উদ্ভাবিত গ্র্যাভিটি-সংক্রান্ত ফর্মুলার পরেই। ‘রায়চৌধুরী ইকুয়েশন’ না থাকলে স্টিফেন হকিং এবং রজার পেনরোজ়ের ফর্মুলা আসত না। ওই ইকুয়েশন এখন বহু ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত অমলকুমার রায়চৌধুরী স্মারক বক্তৃতায় এই মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী অশোক সেন। অশোকের বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ক্লাসিকাল গ্র্যাভিটেশনাল রেডিয়েশন ইউজ়িং কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি’।
গ্র্যাভিটেশনাল রেডিয়েশন হল দুই ভারী বস্তুর (যেমন, ব্ল্যাক হোল কিংবা ১০০,০০০,০০০,০০০,০০০ নক্ষত্রওয়ালা গ্যালাক্সি) সংঘর্ষে উদ্ভূত স্পেসটাইমের কাঁপন। কাঁপনের কোয়ান্টাম প্রকৃতি নিয়ে এ কথা বলেন অশোক। কোয়ান্টাম হল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের বিজ্ঞান। সেটা গ্র্যাভিটির থেকে পুরোপুরি আলাদা।
গ্র্যাভিটি তেল হলে, কোয়ান্টাম হল জল। তেলে আর জলে যেমন মিশ খায় না, তেমনই গ্র্যাভিটি এবং কোয়ান্টাম মেশে না। এ জন্য, গ্র্যাভিটি এবং কোয়ান্টাম মিশিয়ে যে বিজ্ঞান, যা এখনও হাইপোথিসিস পর্যায়ে আছে, সেটার নাম হল ‘কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি’। আন্তর্জাতিক স্তরে যে সব বিজ্ঞানী তেল আর জলে মিশ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন, অশোক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আলোর কণা যেমন ফোটন, তেমনই গ্র্যাভিটির কণা গ্র্যাভিটন, এই হল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলের বিশ্বাস। এক দল বিজ্ঞানী বলেন, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ হল গ্র্যাভিটনের স্রোত।
যেহেতু অমলকুমার রায়চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা, সে জন্য বিভিন্ন বক্তার কথায় বারবার চলে আসে, প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রবাদপ্রতিম মাস্টারমশাই অমলকুমার তথা একেআর-এর কথা। পদার্থবিদ্যার বর্তমান অধ্যাপক সুচেতনা চট্টোপাধ্যায় টেনে আনেন অমলকুমারের সহধর্মিণী নমিতা রায়চৌধুরীর কথা। প্রথম একেআর-সেমিনারে এসে নমিতা বলেছিলেন, কত ‘আনস্মার্ট’ ছিলেন তাঁর স্বামী। একেআর-এর প্রাক্তন ছাত্র প্রসাদ রায় বললেন, ‘‘উনি মোটেই আনস্মার্ট ছিলেন না। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ছিলেন, তখন তাঁর আমি স্যুট-টাই পরা ছবি দেখেছি।’’
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী সুদীপ্তা সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘আমরা অমলকুমারের মেধার বিশ্লেষণ করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, উনি প্রত্যেক দিন কলেজে ঢোকার আগে একটি নির্দিষ্ট চানাচুর বিক্রেতার কাছ থেকে চানাচুর কিনে খেতে-খেতে ঢুকতেন। আমরা বলতাম, স্যারের মেধার মূলে ওই ‘চানাচুর থিয়োরেম’।’’ সুদীপ্তার দিদিও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে পড়েছিলেন। প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপকের প্রথম দিন লেকচার শুনে থ হয়ে যান তিনি। বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছিলেন, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। পরের দিন ক্লাসে ঢুকে একেআর বলেছিলেন, ‘‘তোমরা তো আমাকে বলোনি যে, তোমরা বিএসসি প্রথম বর্ষের পড়ুয়া। আমি এমএসসি প্রথম বর্ষের বিষয় পড়িয়ে দিয়েছিলাম।’’
অশোক বলছিলেন, ‘‘আমরা ৭২ থেকে ৭৫ স্নাতক স্তরের ছাত্র ছিলাম। আমি তার পর কানপুর আইআইটিতে পড়তে গিয়েছিলাম। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ে রাজনৈতিক ভাবে উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ। রোজই একদল উত্তেজিত ছাত্র কলেজের ক্যাম্পাসে ঢুকত। তাদের ঢোকায় বিরোধিতা করতে ছাত্রদের আগে এগিয়ে যেতেন স্যার।’’
অমিতাভ রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘আমার কাকা ছিলেন একেআর। আমরা একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ হয়েছিলাম। বোঝাই যেত না, কে কার সহধর ভাইবোন। এই কৃতিত্ব আমি কাকিমাকে দিতে চাই। কাকিমা কানপুর থেকে আমাদের বাড়িতে আসেন। তার পর আমাদের বাড়িতে অনেক খাবার চালু হয়েছিল। যেমন, আলুকাবলি।’’
সমগ্র অনুষ্ঠানটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, কলকাতা আইসার-এর অধ্যাপক বিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায়। সমগ্র অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত ছিলেন অমলকুমারের মেয়ে পারঙ্গমা সেন।