মনমোহন সিংহ প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে তাঁকে ‘মৌনমোহন’ বলে কটাক্ষ করত বিজেপি। তাদের বাজি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ৫৬ ইঞ্চি ছাতি। কিন্তু বিদেশনীতির ক্ষেত্রে সেই ৫৬ ইঞ্চির ছাতিই উল্টো ফল দিচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রীকে আজ তীব্র কটাক্ষ করলেন বিজেপিরই ঘরের লোক অরুণ শৌরি। মায়ানমার, পাকিস্তান ও নেপালের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বোঝাতে চাইলেন, মোদীর আস্ফালনের ঝোঁক কী ভাবে বিদেশনীতির ক্ষেত্রে ব্যুমেরাং হচ্ছে ভারতের ক্ষেত্রে। শুধু মোদীকে নয়, অটলবিহারী বাজপেয়ী জমানার এই মন্ত্রী বিঁধতে ছাড়েননি মোদীর দুই সেনাপতি অরুণ জেটলি ও অমিত শাহকেও। শৌরির মতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই ত্রিমূর্তি পুরোপুরি দিশাহীন।
বিজেপির অন্দরে আলোচনা, শৌরির প্রত্যাশা ছিল মোদী-মন্ত্রিসভায় অর্থ বা অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হবে। মোদী এ ব্যাপারে শৌরিকে আশ্বাস দিয়েছেন— এমন জল্পনাও একাধিক বার শোনা গিয়েছে রাজধানীতে। কিন্তু হাল আমলে শিকে ছেঁড়েনি এখনও। ৭৫ বছর হয়ে যাওয়া কাউকে মন্ত্রিসভায় না রাখার যে নীতি নিয়ে মোদী চলছেন, তাতে শৌরির হাতে বেশি সময়ও নেই আর। আগামী ১১ নভেম্বর ৭৪ বছর পূর্ণ হবে শৌরির। এই অবস্থায় আপাত ভাবে সরকারের ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ করে প্রাসঙ্গিক থাকার চেষ্টা করলেও তাঁর আক্ষেপটা চাপা থাকছে না। শৌরির কথায়, ‘‘আসলে দিল্লিতে গেলেই সকলে সর্বজ্ঞানী হয়ে উঠেন।’’ এটা ঘটনা, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় মোদী বিভিন্ন বিষয়ে শৌরির পরামর্শ নিতেন। এখন যে মোদী আর তাঁর পরামর্শের প্রয়োজন বোধ করছেন না, সেই খেদটাই কার্যত আজ প্রকাশ্যে এনে ফেললেন শৌরি।
শনিবার কলকাতার অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশেনে ভারত-চিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সমীকরণ নিয়ে বক্তৃতা করতে এসেছিলেন বাজপেয়ী জমানার টেলিকম ও বিলগ্নীকরণ মন্ত্রী শৌরি। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘লাভ জেহাদ খেকে ‘ঘর ওয়াপসি— টুইটারে মোদী সব বিষয়েই সরব। ৫৬ ইঞ্চি ছাতির মোদী যদি বিদেশনীতির ক্ষেত্রে একটু-আধটু মনমোহনের মতো হতেন, তা হলে বরং ভাল হতো। গত এক বছরে বৈদেশিক সম্পর্ক রক্ষার আসল কাজ যেটুকু হয়েছে তার চেয়ে আস্ফালন হয়েছে ঢের বেশি।’’ এর তিনটি উদাহরণও দেন তিনি। তিনটি ঘটনাকেই মোদীর বিদেশনীতির সাফল্য হিসেবে প্রচার চালিয়েছে শাসক দল। এবং প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। যদিও শৌরির কথায়, ‘‘বিদেশনীতি রূপায়ণে আস্ফালনই সব চেয়ে সর্বনেশে। কারণ, তিনটি ক্ষেত্রেই নয়াদিল্লি ইতিবাচক ভূমিকা নেওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট দেশগুলির সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে।
ঘটনা তিনটি কী?
• মোদী সরকারের দাবি, ভারতীয় সেনা এই প্রথম মায়ানমারে ঢুকে বিশেষ অভিযান চালিয়ে কয়েকশো জঙ্গিকে নিকেশ করেছে। সার্বভৌমত্বের প্রশ্নেই এমন কোনও অভিযানের কথা স্বীকার করেনি মায়ানমার।
• রাশিয়ায় উফায় পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে মোদীর যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে নয়াদিল্লি জোর গলায় দাবি করেছিল, ইসলামাবাদ এই প্রথম সন্ত্রাস রোধে ভারতের নীতি সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছে এবং যৌথ বিবৃতিতে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু দেখা যায়, এর পরেই সীমান্তে উত্তেজনা বেড়ে গিয়েছে। ভেস্তে যায় বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠকও।
• নেপালের ভূমিকম্পের পর ভারত যে ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল তা ও এক কথায় অভূতপূর্ব বলে বিজেপির দাবি। অথচ নেপালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে রীতিমতো হেনস্থা হতে হয়েছে এই প্রশ্নে।
ভারত-চিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সমীকরণ নিয়ে শৌরির বিশ্লেষণ, বিদেশনীতি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এখানে ধীরে ধীরে নীরবে দীর্ঘ সময় নিয়ে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়। চিন এই কারণেই সফল। আর ভারত তাদের থেকে পিছিয়ে। ২০০৮ সালের পর থেকে চিন যে ভাবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, নিজেদের মতামত স্পষ্ট করে জানিয়েছে, তা শিক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে বেজিংয়ের অবস্থান, কাশ্মীর বিষয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন বা জাপানের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
তার পরেও চিনের শেয়ার বাজারে ধস, অভ্যন্তরীণ সমস্যা, কমিউনিস্ট পার্টিতে দূর্নীতির কথা তুলে শৌরি বলেন, ‘‘চিনে ডামাডোল চললে আমাদের খুশি হওয়ার কারণ নেই। কারণ প্রবল জাতীয়তাবাদী এই দেশ যদি সমস্যায় পড়ে তা হলে সে দেশের নেতৃত্ব অচিরেই তার মোড় বিদেশের দিকে ঘুরিয়ে দেবে।’’ প্রতিবেশী হিসেবে তার মাসুল ভারতকে দিতে হতে পারে।’’
শৌরির বক্তব্যের সূত্র ধরেই চিন বিশেষজ্ঞ মনোজ জোশী এবং প্রাক্তন সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায়চৌধুরীও ভারত-চিন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে বেশ কিছু সতর্কবার্তা শোনান। তাঁদের বক্তব্য, চিন যে নীতি গ্রহণ করে তার সফল রূপায়ণ করে। ভারতে নীতি নির্ধারণ হয় ঢাক পিটিয়ে। কিন্তু সেগুলি বাস্তবায়িত হয় না। উভয়েই সদ্য অনুষ্ঠিত বেজিংয়ের সামরিক কুচকাওয়াজের কথা উল্লেখ করে জানান, সারা পৃথিবী এর থেকে বার্তা পেয়েছে। ভারত কি কিছু শিখেছে?
কলকাতায় চিনের কনসাল জেনারেল মা ঝানউ অবশ্য বিশেষজ্ঞদের যাবতীয় উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘চিনের বিদেশনীতির মূল ভিত্তিই হল শান্তিপূর্ণ উন্নয়ন ও সহযোগিতা। ভারত এবং চিনের একসঙ্গে বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’’