পাশে সবাই, লড়াই জারি কাশ্মীরে

জরুরি বার্তা এসেছিল। কিন্তু প্রায় অসম্ভব ছিল শ্রীনগরের ওই প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে জল ভেঙে পৌঁছনোটা। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে যা-ও বা পৌঁছনো গেল, বাড়িটির ওপরের তলা ছাড়া বাকি সবটাই জলের তলায়। সেই ওপর তলায় চড়ে, জানলা ভেঙে সাত দিনের শিশুটিকে উদ্ধার করলেন এক সেনা জওয়ান। খিদেয়, ঠান্ডায় নেতিয়ে পড়া ছোট্ট প্রাণটাকে তরুণী মায়ের কোল থেকে তুলে, তোয়ালে দিয়ে মুড়ে খুব সাবধানে অন্য এক সেনার হাতে দিলেন তিনি।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

শ্রীনগর শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:২৫
Share:

কপ্টারে উদ্ধার। দুর্গতদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ত্রাণ শিবিরে।

জরুরি বার্তা এসেছিল। কিন্তু প্রায় অসম্ভব ছিল শ্রীনগরের ওই প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে জল ভেঙে পৌঁছনোটা। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে যা-ও বা পৌঁছনো গেল, বাড়িটির ওপরের তলা ছাড়া বাকি সবটাই জলের তলায়। সেই ওপর তলায় চড়ে, জানলা ভেঙে সাত দিনের শিশুটিকে উদ্ধার করলেন এক সেনা জওয়ান। খিদেয়, ঠান্ডায় নেতিয়ে পড়া ছোট্ট প্রাণটাকে তরুণী মায়ের কোল থেকে তুলে, তোয়ালে দিয়ে মুড়ে খুব সাবধানে অন্য এক সেনার হাতে দিলেন তিনি। পরে তাঁদের এক সহকর্মী বলছিলেন, “এই মুহূর্তটার জন্য আজ আমরা সব চেয়ে গর্বিত।”

Advertisement

সেনাদের এ রকম অসংখ্য ‘গর্বিত’ মুহূর্তের জন্যই বন্যাদুর্গত জম্মু-কাশ্মীরে উদ্ধার হয়েছেন এক লক্ষ দশ হাজারেরও বেশি মানুষ। কাশ্মীরের সাহায্যে একজোট হয়েছেন শাসক ও বিরোধী নেতারা। দেরিতে সাহায্য আসার অভিযোগ তুলে কিছু মানুষ অবশ্য বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, পাথরও ছুড়েছেন। তাতে বিচলিত না হয়ে সেনা এখন দুর্গম থেকে দুর্গমতম জায়গায় আটকে থাকা প্রতিটি মানুষকে উদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর। বালচন্দ্রন নামে এক বায়ুসেনার কথায়, “পরিস্থিতি এমনই যে, মানুষের ক্ষোভ সঙ্গত। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আতঙ্ক বাড়তে দেওয়া চলবে না।” আটকে থাকা মানুষের সংখ্যাটা এখনও প্রায় চার লক্ষ হলেও উদ্ধারকারী দলের উপরেই ভরসা রাখছে রাজ্য প্রশাসন।

শুধু আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করাই নয়, বাকি দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ভূস্বর্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল করতেও দিনরাত এক করে কাজ করে চলেছে সেনা। বিএসএনএল মোবাইলের একটি টাওয়ার কার্গিল থেকে শ্রীনগরে আনা হয়েছে। বসানো হয়েছে একাধিক অস্থায়ী টেলিফোন বুথ। তার ফলে বাদামিবাগ-সহ কিছু অঞ্চলে আংশিক ভাবে সচল হয়েছে টেলি যোগাযোগ। মোবাইল চার্জ করার ব্যবস্থা-সহ ৩৮টি জেনারেটর আনা হয়েছে। সড়কপথ খোলার কাজও অনেকটাই এগিয়েছে। কিছু অঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিভিশনাল কমিশনার কাশ্মীর রোহিত কাঁসাল। তিনি এ-ও জানান, আজ বিকেলের মধ্যে সব সরকারি কর্মচারীকে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রশাসন। সরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে সাধারণের জমা রাখা সব অর্থ সুরক্ষিত আছে বলেও জানান তিনি।

Advertisement

বৃষ্টি থেমেছিল আগেই। ভূস্বর্গবাসীকে স্বস্তি দিয়ে আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আপাতত নতুন করে আর বৃষ্টির আর সম্ভাবনা নেই। জলস্তর অনেকটাই নেমেছে। তবে উদ্ধারকারী দল গিয়ে পৌঁছনোর পরেও অনেকেই বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছেন না বলে সেনা সূত্রের খবর। সে সব জায়গায় পর্যাপ্ত খাবার, পানীয় জল, ওষুধপত্র পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। বিপর্যয়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটতেই সামনে আসতে শুরু করেছে ধ্বংসের বাস্তব চিত্র। ত্রাণ শিবিরে সর্বহারাদের হাহাকার, স্বজনহারাদের কান্না। মৃতের সংখ্যা দু’শো পেরোনোর পর কত দূর গিয়েছে তা নিশ্চিত বলা যায়নি। আজও জল-স্থল-আকাশ পথে দিনভর উদ্ধারকাজ চালিয়েছে সেনা ও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। বায়ুসেনার ৮৪টি হেলিকপ্টার উড়ছে বন্যাবিধ্বস্ত এলাকাগুলির আকাশে। ১৫০টি ত্রাণ শিবির বসিয়েছে প্রশাসন। প্রায় এক লক্ষ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে।


উদ্ধারকাজ চলছে পুরোদমে। বৃহস্পতিবার শ্রীনগরে।

সাহায্য আসছে নানা মহল থেকে। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমান ২০০ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া-সহ ৫০০ জন যাত্রীকে শ্রীনগর থেকে দিল্লি পোঁছে দিয়েছে বিনামূল্যে। এয়ার ইন্ডিয়ার অন্য একটি বিমান পৌঁছে দিচ্ছে ত্রাণসামগ্রী। উদ্ধারকারী কপ্টার ও বিমানের জ্বালানির জোগান দিতে এগিয়ে এসেছে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন (আইওসি), ভারত পেট্রোলিয়াম, হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়ামের মতো সংস্থা। আইওসি-র চেয়ারম্যান বলেন, “উদ্ধারকাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে সেনা। আমরাও পেছনে আছি। জ্বালানির অভাবে উদ্ধারকাজ আটকাবে না।” সাহায্য করছে রেলও। জম্মু, উধমপুর ও কাটরায় রেলের সহায়তা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরের তরফে জানানো হয়েছে, বন্যাদুর্গতদের জন্য আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করতে প্রস্তুত তারা।

উদ্ধার ও ত্রাণকার্যে নরেন্দ্র মোদী সরকার পাশে পেয়েছে বিরোধীদেরও। এক লক্ষ টন ত্রাণসামগ্রী পাঠিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। সেই ট্রাকগুলি রাস্তা খোলার অপেক্ষায় পাঠানকোটের কাছে আটকে আছে বলে জানিয়েছেন তিনি। ত্রাণ পাঠিয়েছে কংগ্রেস শাসিত রাজ্য হরিয়ানা। মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা জানান, পঞ্চাশ লক্ষ টাকার খাবার ও ওষুধপত্র বোঝাই ১০টি ট্রাক রওনা দিয়েছে। কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিংহ বলেছেন, “কেন্দ্র ও রাজ্য যে ভাবে বিপর্যয়ের মোকাবিলা করছে, তা প্রশংসনীয়।” গোয়ার কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পারিক্করও বলেন, “এই ভয়ঙ্কর বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে যথেষ্ট ভাল পদক্ষেপ করেছেন মোদী।” পাশাপাশি, ছত্তীসগঢ় সরকারও দশ কোটি টাকার ত্রাণসামগ্রী পাঠানোর কথা ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রত্যেক কর্মচারী তাঁদের এক দিনের বেতন প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিলে দেবেন বলে জানিয়েছেন।

এ দিকে, মোদীর রাজ্য গুজরাতেও ভারী বৃষ্টির চোখরাঙানিতে চূড়ান্ত সতর্কতা জারি হয়েছে। বডোদরার বিশ্বামিত্রি নদীর জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। ডুবে গিয়েছে একাধিক সেতু। শহরের পশ্চিম অংশটি কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বাকি শহর থেকে। কুড়ি হাজারেরও বেশি মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরানো হয়েছে ইতিমধ্যেই। সেখানেও কাজে নেমেছে সেনা ও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী।

প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের বন্যাবিধ্বস্ত ছবিও শোচনীয় হচ্ছে। মৃতের সংখ্যা ২৫০ ছাড়িয়েছে। ঘরছাড়া কয়েক লক্ষ। চন্দ্রভাগা নদীর জলোচ্ছ্বাস এখনও কমেনি। সেখানেও উদ্ধারে নেমেছে সেনা।

ছবি: পিটিআই।

খোঁজ নেই বাঙালি পরিবারের

গত মাসের ২৭ তারিখে বাগুইআটি থানা এলাকার নারায়ণপুরের বাসিন্দা রশিদা খাতুন ও হাবিবুল কলু তাঁদের মেয়ে, জামাই ও নাতনিদের নিয়ে শ্রীনগরে বেড়াতে গিয়েছিলেন। শ্রীনগরের হাজান জেলায় রশিদার দিদি হামিদা খাতুনের বাড়ি। হামিদার স্বামী বসির আহমেদ কলু পেশায় কাঠের মিস্ত্রি। রশিদার বাবা শেখ আকবর আলি বৃহস্পতিবার বলেন, “২ সেপ্টেম্বর মেয়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছে। তার পর থেকেই কোনও খবর পাচ্ছি না। খুব দুশ্চিন্তায় আছি।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement