অতীতের ভুল থেকেও অসম পুলিশ যে সতর্ক হয়নি, তা ফের বুঝিয়ে দিচ্ছে চিরাং। তদন্তে ঢেলেমির জেরে অসমের মাটিতে লুকিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ চলছে জেহাদিদের। গোয়েন্দা সূত্রে এমনই খবর মিলেছে।
কিন্তু গাফিলতি মেনে নেওয়া দূরের কথা, জেহাদি ধরার ‘কৃতিত্ব’ নিতেই ব্যস্ত রাজ্য সরকার। অসমে জেহাদিদের ঘাঁটি ও তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের কথা স্বীকার করলেও মুথ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ দাবি করেছেন— বড় কোনও নাশকতার আগেই জঙ্গিদের গ্রেফতার করা গিয়েছে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর বরপেটা থেকে জেহাদি সংগঠনের নেতা শাহনূর আলম গ্রেফতার হওয়ার পর গগৈ একই কথা বলেছিলেন।
কিন্তু নামনি অসমে জেহাদি কর্মকাণ্ডের কথা যত সামনে আসছে, ততই প্রকট হচ্ছে অসম পুলিশের গুপ্তচর ব্যবস্থার অকর্মণ্যতা। জানা গিয়েছে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় বসেও অস্ত্র তৈরি করছিল জেহাদিরা।
পড়শি পশ্চিমবঙ্গে খাগড়াগড়-কাণ্ড না ঘটলে হয়তো অসমে জামাতুল মুজাহিদিনের (বাংলাদেশ) কর্মকাণ্ড এখনও চোখের আড়ালেই থেকে যেত। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তেই অসমের ‘ডাক্তারবাবু’র সন্ধানে নামে এনআইএ। জানা যায়, দাঁতের ডাক্তার সেজে বরপেটায় বসে জেহাদি কাজকর্ম চালাচ্ছিল শাহনূর আলম। তাঁর স্ত্রী সুজেনাও ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জেহাদি। বোরখা বিক্রি, দাঁতের চিকিৎসা, ধর্মালোচনার আড়ালে নামনি অসমে বিশেষ করে বরপেটা ও নলবাড়ি জেলায় যে এ ভাবে জেএমবি কর্মকাণ্ড চলছিল তাঁর সামান্য আঁচও আগে পায়নি অসমের পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগ। বরপেটা-নলবাড়ি মিলিয়ে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হলেও পালিয়ে যায় জামাতের বড় মাথারা। তাদের মধ্যে ছিল আশিক ওরফে বুড়াভাই। পাশাপাশি বিএসএফ জানতে পারে, রাজনৈতিক মদত ও একটি মুসলিম সংগঠনের ছত্রছায়ায় ধুবুরি থেকে বাছাই করা যুবকদের বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে জেহাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু বিস্ফোরণ-কাণ্ড নিয়ে হইচই মিটে যেতেই পুলিশ ফের তদন্তে ঢিলেমি দেখায় বলে অভিযোগ। যার ফলে বুড়াভাইয়ের নেতৃত্বে অসমে জেহাদিদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির করা হয়। এক আইবি অফিসার জানান, খাগড়াগড় কাণ্ডের পরই বুড়া ভাই গা-ঢাকা দিয়েছিল। ভাবা হয়েছিল, সে বাংলাদেশে পালিয়েছে। কিন্তু, সে যে অসমে বসেই ফের নতুন এক দল যুবককে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল তা জানা যায়নি। নামনি অসম ও বড়োভূমিতে ছ’মাস ধরে প্রায় চার হাজার জওয়ান জঙ্গি দমন অভিযান চালাচ্ছেন। অভিযানে মূলত নির্ভর করা হচ্ছে ‘সোর্স’ মারফত পাওয়া খবরের উপর। আইবির বক্তব্য, প্রতিটি জেলায় যে ভাবে যৌথ বাহিনীর নজরদারি চলছে, তারই মধ্যে এ কে ৪৭ ধাঁচের রাইফেল তৈরি, সামরিক পোশাক জোগাড় করে নতুন সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হল। পুলিশের আশঙ্কা, স্থানীয় গ্রামবাসীদের সমর্থন পেয়েছিল জেহাদিরা। তাই, তাদের গোপন শিবিরের কথা পুলিশের কানে পৌঁছয়নি। অসম পুলিশের আইজি এল আর বিষ্ণৈ দাবি করেন, সূত্র মারফত খবর পেয়েই গত এক সপ্তাহের অভিযানে ১০ জন জামাতুল মুজাহিদিন জঙ্গিকে ধরা হয়েছে। মিলেছে ১০টি হাতে তৈরি এ কে রাইফেল, ২৮টি সামরিক উর্দি, ২টি হাতে গড়া ইনস্যাস। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, অস্ত্র তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম জোগাড় করত জঙ্গিরা। পরে, ডাউকা নগরে সেগুলি জুড়ে গোটা অস্ত্র তৈরি করা হতো। পলাতক দুই জেহাদি— বরপেটার আশিক ও সুলেমান আলি অস্ত্র তৈরিতে দক্ষ ছিল। পুলিশ জানতে পেরেছে, কয়েক বার বাংলাদেশ থেকে জেএমবি নেতারাও বরপেটা, চিরাং-এ এসে স্থানীয় যুবকদের ‘মগজ ধোলাই’ করে গিয়েছেন। চিরাং-এর এসপি রঞ্জন ভুঁইঞা জানান, এদের সঙ্গে আর কারা জড়িত, অস্ত্র কারখানা কোথায় ছিল তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, শাহনূর আলমের ‘মডিউল’ এবং চিরাং ‘মডিউল’ আলাগা। ধৃতদের মধ্যে ৮ জন একেবারেই নীচের স্তরের সদস্য। বাকি দু’জনও মডিউল সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। কিন্তু আইবির মতে, আশিকের নাম দু’টি মডিউলেই জড়িত। তাই তাকে ধরতে পারলে নামনি অসমে জেহাদি কার্যকলাপের বিষয়ে জানা সম্ভব হবে।
পুলিশের আশঙ্কা, এক দিকে বর্তমানে রাজ্যে বাংলাদেশি চিহ্নিতকরণ ও বিতাড়ন নিয়ে আন্দোলন চলছে। অন্য দিকে, আসছে নির্বাচন। এই সময় রাজ্যের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা চলবে। সে দিকে তাকিয়ে বরপেটা, ধুবুরি, বরাক, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ, নলবাড়ি জেলা ও বড়োভূমিতে পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।